চারদিক-বাইক্কা বিলে পাখির আসর by আকমল হোসেন নিপু

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পেট থেকে গ্রামের দিকে ঢুকে গেল একটি গ্রামীণ পাকা সড়ক। দুপাশে বাঁশঝাড়, দেশি-বিদেশি গাছের সারি। ফাঁকে ফাঁকে কাঁচা-পাকা ঘর। গ্রামের পথ পেরিয়ে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাত্ চোখের সামনে খুলে যায় খোলা প্রান্তর। দূরে দূরে গ্রামগুলো দাঁড়ানো।


সে প্রান্তরের বুকে বোরো ফসলের নতুন চারার শরীর দোলানো কাঁপন। মাটির কাঁচা পথ। ধুলো উড়িয়ে চলছে গাড়ি। কবছর আগেও এ পথ দিয়ে এ রকম গাড়ির আনাগোনা দেখেনি এলাকার মানুষ। রাস্তার পাশে ছাড়া ছাড়া বাড়িগুলো ধুলোয় যেন ঢাকা পড়ছে। ঘরের চালে, গাছের পাতায়, মাথার চুলে ধুলোর সর জমছে।
আর এ পথটি শরীর বাঁকিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে বাইক্কা বিলে। বাইক্কা বিল একটা জলাশয়ের নাম। মৌলভীবাজার জেলার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিস্তৃত হাইল হাওরের বুকে কোনোমতে টিকে থাকা আর দশটা বিলের একটি। ক-বছর আগেও এ রকম একটি বিলের নাম মানুষ জানত না। কে আর অত বিলের খোঁজখবর রাখে। অনেক বিলই তো এরই মাঝে ভরে গেছে। যে বিলগুলো একসময় জিওল মাছের খনি ছিল। এলাকার লোকজন বলেন, হাইল হাওরে পানির টান পড়লে কই, মাগুর, শিং মাছ ছিল বেশুমার। এই হাওরের কই মাছের সুনাম এখনো অনেকের মুখে মুখে ফেরে। হাইল হাওরের বিশাল বিশাল ভাজা কই মাছ আর বিন্নি ধানের ভাত—শীতসকালের অতিথি আপ্যায়নে এর কোনো তুলনাই ছিল না। এটা যে খুব বেশি দিন আগের কথা, এমনও নয়। এলাকার মানুষ জানায়, তাদের চোখের সামনে মাত্র বছর কয়েকে সব পাল্টে গেল। বিলগুলো শুকিয়ে মাঠ। জল না থাকলে মাছ আর থাকবে কোথায়! মাছ কমে গেছে, কিন্তু মাছের চাহিদা তো কমেনি। এই মাছ ধরে কত মানুষ জীবিকা চালায়। হাওরে মাছ কমার ফল হয়েছে ডিমে-ছাওয়ে মাছ ধরে এরই মধ্যে মাছের বংশ বিনাশ করার কাজও মোটামুটি এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর শীতের হাওরে পাখি—এটা তো ছিলই। নানা রঙের, নানা জাতের পাখি। হাঁসই ছিল অনেক জাতের। মানুষ আর পাখি কেমন দুই প্রতিবেশী ছিল কতকাল। তার পরও কিছু মানুষ যে পাখি শিকার করত না, এমন নয়। সেই পাখি বন্দুক দিয়ে শিকার করেছে, জালের ফাঁদ দিয়ে ধরেছে। হাজার মাইলের ওপার থেকে উড়ে আসা পাখির ঝাঁক আর সমানভাবে ফেরত যেতে পারেনি। এর ফল হলো, সেই পাখি আসা কমতে থাকে। দিনে দিনে পাখিশূন্য হয়ে পড়ে হাওর। হয়তো তারা অন্য কোথাও পথ খুঁজেছে, ঠাঁই খুঁজেছে। কিন্তু নামে হোক, তবু একটা হাওর আছে। সেই হাওরে মাছ থাকবে না, পাখি থাকবে না— সেটা কি হয়!
সেই হাইল হাওরের প্রায় ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমি বাইক্কা বিল। বেসরকারি সংগঠন ম্যাচ (ম্যানেজম্যান্ট অব অ্যাকুয়াটিক সিসটেম থ্রো কমিউনিটি হাজবেনট্রি) প্রকল্প বাইক্কা বিলে স্থায়ী অভয়াশ্রম গড়ে তোলে। বিলটি হয়ে ওঠে মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখানে মাছ ধরা, জলজ উদ্ভিদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। সুফলও মেলে। বিলুপ্তপ্রায়, বিপন্ন নানা জাতের মাছ এখানে ডিম পাড়ে, বংশ বিস্তার করে। বর্ষায় হাওরের বিস্তীর্ণ জলাশয়ে এই বাইক্কা বিলের মাছ ছড়িয়ে পড়ে। শুধু কি মাছ বেড়েছে, বেড়েছে শাপলা, পদ্ম, মাখনাসহ নানা জাতের জলজ উদ্ভিদ। বর্ষায় ফুল ফুটলে বাইক্কা বিল রং বদলে হয়ে যায় আলাদা রকম, নজরকাড়া।
আর এসেছে পাখির ঝাঁক। বাইক্কা বিলে পাখিকে কেউ বিরক্ত করে না। পাখি তার আপন মনে জলে ভাসে, উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, কিচিরমিচির করে। অনেক জাতের পাখি। এবার ৪০ প্রজাতির ১২ হাজারের বেশি পাখি এসেছে বাইক্কা বিলে। দেখা মেলে লেজা হাঁস, সরালি, পাতিসরালি, বেলেহাঁস, ধলা বালিহাঁস, মরচে রঙের ভুতিহাঁস, বেগুনি কালেম, পাতি পানমুরগি, নিউ পিপি, মেটেমাথা টিটি, লালচে বক, ঢুপনি বক, পানকৌড়ি, পাতি চ্যাঙ্গা, ভুবন চিল, ফিঙে, সাদা বক, রাঙা বক, কানি বক, দেওটা, কালামাথা কাস্তেচরা, বিপন্ন জাতির পালাসি কুড়া ইগল, গুটি ইগল...। এই পাখিই এখন বাইক্কা বিলকে সরগরম করে রেখেছে। শুধু শীতকালেই নয়, উভচর অনেক পাখি সারা বছরই বাইক্কা বিলে চরে বেড়ায়। চোখে পড়ে মায়া লাগা বেগুনি কালিম। চুপি চুপি পা ফেলে বিলের কিনার ধরে, শাপলার ফাঁকে, কচুরিপানার ঝোঁপে, ঘাসের বুকে, ঘাগরার সবুজে হাঁটে। মানুষ কাছে গেলে ইচ্ছে হলে উড়াল দেয়, কখনো আস্তেধীরে পা ফেলে সরে যায়। বিল এলাকার আদর মিয়া বলেন, ‘কেউ এখানে পাখিরে ডিস্টার্ব করে না। পাখি ধরতে কেউ আসে না। পাখি দেখতে আসে।’
পাখির আসর দেখতে এখন হাওরের বুকের ওপর দিয়ে তৈরি হওয়া কাঁচা পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে ছুটছে গাড়ি। গ্রামীণ শান্ত স্তব্ধতা মাঝেমধ্যেই ভেঙে পড়ছে। আসছেন পর্যটকের দল। শুধু দেশি পর্যটকই নয়, হঠাত্ করেই চোখে পড়ে ভিনদেশি মানুষ। বাইক্কা বিলে দূরদেশি পাখি দেখতে ছুটে আসছেন দূরদেশি পর্যটকেরাও। অবাক চোখ মেলে শিশুর দল এসব গাড়ি দেখে, মানুষ দেখে। একচিলতে হিজলের বনপথ দিয়ে টাওয়ারে উঠে দুরবিনে চোখ রাখছেন কেউ। কেউ বা নৌকা নিয়ে বিলে ভাসছেন। পাখিরাও যেন মানুষের এই দেখার সাধ পূর্ণ করতে জল কাঁপিয়ে, বাতাসে দোলা দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে। পাখির ছায়া পড়ে বিলে, পদ্মপাতায়। পাখি-মুগ্ধতায় হইচই করে ওঠে পাখির আসরে আসা মানুষের দল। তবে ভয়ও আছে কারও কারও, যদি বাইক্কা বিল পর্যন্ত রাস্তা পাকা হয়ে যায়। যদি মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে সেখানে, তাহলে পাখির এই নিরাপদ আসর থাকবে তো! আমরা তো বেশি দিন কিছু ধরে রাখতে পারি না।

No comments

Powered by Blogger.