আমার ভাষা আমার একুশ-বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাব ও আধিপত্য by সৌরভ সিকদার

মধ্যযুগে এ দেশের রাজ এবং দাপ্তরিক ভাষা—উভয়ই ছিল ফারসি। তাই আঠারো শতক বা তার আগে যেসব ইউরোপীয় বণিক, ধর্মযাজক প্রমুখ এদেশে এসেছিলেন, তাঁরা আগে ফারসি ভাষা শিখে নিতেন। স্যার উইলিয়াম জোন্স, হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরি, ডানকান প্রমুখ ছিলেন তাঁদের দলে।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং উনিশ শতকে এসে ব্রিটিশ শাসন (১৮৩৫) কায়েম হলে ফারসির আধিপত্য খর্ব হতে থাকে। ফারসির পরিবর্তে শাসকগোষ্ঠী বাংলা শিখতে উদ্যোগী হয়। যার ফলে সৃষ্টি হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ১৮০১ সালে সেখানে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শিখিয়ে এ দেশে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘমেয়াদি করার চেষ্টা চলে। এর পর ১৮১৭ সালে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে বাঙালিদের ইংরেজি শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
ফাদার জেমস রং-এর এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত ছয় হাজার বাঙালি ইংরেজি শেখে। তখনকার পরিবর্তিত আর্থ-রাজনৈতিক পটভূমিতে ইংরেজি শেখা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি চাকরি, বিশেষ করে সাহেবদের মুন্সি, কেরানি এবং দোভাষীর লোভনীয় পদ লাভ ছিল এই ইংরেজি-প্রীতির উত্স।
সুবিধাভোগী শ্রেণী সেদিন ইংরেজি চর্চা করতে গিয়েছিল আর্থিক সুবিধার জন্য। ইংরেজি ভাষা জেনে বাংলাকে সমৃদ্ধ করতে তারা শ্রীরামপুর মিশন কিংবা স্কুল বুক সোসাইটিতে যোগ দেননি—যেমনটি করেছিলেন মধুসূদন—বিদেশি ভাষা শিখে সমৃদ্ধ করেছেন মাতৃভাষা ও সাহিত্যকে। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে এ দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলা ভাষার ওপর ইংরেজির প্রভাব শুরু হয় উনিশ শতকে। লর্ড উইলিয়াম বেনটিংয়ের শিক্ষা-সংস্কারের পর বাংলার ওপর ইংরেজির প্রভাব বাড়তে থাকে। এ সময়ে নানা ধরনের ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে বাংলা শব্দভান্ডারে ও প্রাত্যহিক জীবনে, যেমন—ডাক্তার (ডক্টর), হাসপাতাল (হসপিটাল), আপিস (অফিস), শান্ত্রি (সেন্ট্রি), লাট (লর্ড) প্রভৃতি। লক্ষণীয়, সেকালে ইংরেজি শব্দের বাঙালিকরণ হয়েছিল, আর আজ দুই শ বছর পর বাংলা শব্দের ইংরেজিকরণ চলছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাব এবং বর্তমান অবস্থা দেখতে এবার কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরতে চাই। বাংলা ভাষার গবেষক নবেন্দু সেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা বিশ্লেষণ করে ভাষা-পরিসংখ্যানগত কিছু উপাত্ত তুলে দেখিয়েছেন (বাংলা গদ্য-১৯৯০)। বিদ্যাসাগরের রচনায় দেশি এবং বিদেশি শব্দের হার ছয় দশমিক শূন্য এক ভাগ (তত্সম ও তদ্ভব মিলিয়ে বাকিটা)। এর এক শ বছর পর ১৯৫২ সালে মুহম্মদ এনামুল হক রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র এবং জসীমউদ্দীনের লেখা বিশ্লেষণ করে দেখান—শুধু বিদেশি শব্দই (দেশি মাত্র ২) প্রয়োগ করেছেন ৮ ভাগ। এর মধ্যে আরবি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি রয়েছে। বিশ শতকের আশির দশকে প্রযুক্তি আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসে বিশ্ব যখন একটি গ্রামে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাব যে কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে, সে বিষয়ে একটি তথ্য রত্নেশ্বর ভট্টাচার্য (১৯৯০) জানিয়েছেন—১৯৮৬ সালে শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব গুহর ‘জে ফর জেলাসি’ গল্প। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর গল্প এটি। এ গল্পের একটি পৃষ্ঠায় (৩৮৩) ৮৩০টি শব্দের মধ্যে ইংরেজি ছিল ১১৮টি। অর্থাত্ প্রতি আটটি শব্দের একটি ইংরেজি। কী ভয়ংকর তথ্য! বাংলা ভাষা ইংরেজি হতে আর কতটুকু বাকি! সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষদের জীবনযাত্রার যে গল্প অন্য লেখকরা লিখেছেন, সেখানেও এই অনুপাত প্রায় কাছাকাছি। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন—এই শ্রেণী কমপক্ষে প্রতি দশটি শব্দের একটি ইংরেজি ব্যবহার করে। এরপর আরও দুই যুগ পার হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কথা বাদই দিলাম। আজ একুশ শতকের বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত শ্রেণীর ব্যবহূত বাঙালির মাতৃভাষার শতকরা দশ ভাগ কী তার ও বেশি ইংরেজি যে খেয়ে নিয়েছে—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শুধু কি শব্দ? ইংরেজি বাক্য গঠন-প্রণালী এবং বাগ্ভঙ্গিও এখনকার বাংলায় অবলীলাক্রমে বেড়েই চলেছে। বলিভিয়ার দুটি স্থানীয় ভাষা ‘আয়মারা’ এবং ‘কুয়েছুয়া’র বেলায় কী ঘটেছিল তা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। তেল ও সিসার আকর্ষণে যখন স্প্যানিশরা দলে-দলে বলিভিয়ায় আসতে লাগল, তখন কয়েক বছরের মধ্যেই সৃষ্টি হলো স্প্যানিশ আয়েমারা ও কুয়েছুয়া খিচুড়ি ভাষার। বলিভিয়ার প্রায় এক কোটি মানুষের মধ্যে আজ এক-দশমাংশ শুধু নিজেদের ভাষা জানে। নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক দূরদৃৃষ্টির অভাবে ওরা ভাষার বদল রক্ষা করতে পারেনি। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ভয়ের কারণ আছে। ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি নিজে সেধে ইংরেজি শিখতে গেছে, যদিও তেমন বিদ্যালয় ছিল না। তাই সে জোড়াতালি দেওয়া ইংরেজি শিখেছে।
বাংলা ভাষায় ইংরেজির প্রভাব ও আধিপত্য বিষয়ে শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন—‘আমার মনে হয়েছে দেশে অনাবশ্যকভাবে ইংরেজির ব্যবহার হচ্ছে। এর বড় প্রমাণ শহরের দোকানের নামফলক। এ প্রবণতা বেশি উত্কটভাবে ধরা পড়েছে। এখানে একটা মনোভাব কাজ করে বলে আমার ধারণা—সামান্য দোকান, যার নামকরণ ইংরেজিতে প্রয়োজন নেই—সে যেন জাতে উঠল। এর জন্য দায়ী আমাদের নিজের ভাষা সম্পর্কে হীনমন্যতা এবং এই হীনমন্যতার প্রকাশ শুধু দোকানের নামকরণে নয়। আমাদের শিক্ষাদানে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে এখন এখানে এক ধরনের শ্রেণী-বিভাজন তৈরি হচ্ছে। যাদের কিছু অর্থ-সম্পদ আছে, তারা সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। একটা বাস্তবতা এখানে কাজ করছে, তা হলো স্কুলের পড়াশোনার মান সম্পর্কে—সাধারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান প্রত্যাশানুরূপ না হওয়ায়। কাজেই এ প্রবণতা রোধ করার একটি মাত্র উপায়—সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা। উচ্চতর পর্যায়ে এতগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য শিক্ষার গুরুত্ব বড় করে দেখতে হবে এবং এর পেছনে বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।’
ইংরেজি রাজ-ভাষা থেকে বহুজাতিক বিদেশি ভাষা হয়েছে। এ থেকে আমাদের শেখার বহু কিছু আছে, গ্রহণেরও আছে, কিন্তু বাংলা বিসর্জন দিয়ে কিংবা বিকৃত করে নয়। দেশে থেকে মায়ের ভাষার পরিবর্তে যারা অকারণে-অপ্রয়োজনে ইংরেজি প্রয়োগ করে—তাদের সে ভাষা শুধু লোক দেখানোই নয়, দুর্বল ভাষাবোধ এবং চৈতন্য দুর্বলতার লক্ষণও এটি। অহংকার করলে মাতৃভাষাতেই করা যায়। বর্তমান বাংলা ভাষায় অকারণ ইংরেজির প্রভাব সমাজে শ্রেণীবৈষম্যই বাড়াচ্ছে, প্রকৃত ইংরেজির চর্চা আর জ্ঞান-শাখায় মাতৃভাষার উন্নয়ন ঘটছে না। আমরা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে নেই। ওটা ‘জ্ঞানার্জন ও প্রয়োজনের ভাষা’; কিন্তু আমার মাতৃভাষা নিত্যদিনের ভাষা, স্বপ্ন দেখার ভাষা। একুশের অহংকার যে জাতির জীবনে, তারা কি একুশ শতকে এসে ইংরেজি ভাষায় উনিশ শতকীয় স্বপ্ন দেখাবে?
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.