সরল গরল-রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম নিয়ে বিতর্ক by মিজানুর রহমান খান

জেলা জজদের উচ্চমর্যাদায় উন্নীত হওয়ায় অনেকের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁদের অনেকের বক্তব্যে মনে হয়েছে, এটা না হলেও তো চলে! লক্ষ করার বিষয় হলো, হাইকোর্টের রায়ের আগে তাঁদের এ কথা কখনো মনে হয়েছে বলে জানা যায় না। আকবর আলি খান একে শুধুই দাওয়াত দেওয়ার বিষয় হিসেবে দেখেছেন।


বলেছেন, এর উদ্দেশ্য ও কোথায় কী কাজে ব্যবহার হবে তার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু তা ঠিক নয়। বিধিতেই বলা আছে, রাষ্ট্রীয় ও আনুষ্ঠানিক উপলক্ষসহ সব ধরনের সরকারি উদ্দেশ্যে প্রিসিডেন্সের ব্যবহার হবে।
বাংলাদেশের সমাজপতিদের অনেকে বিচার বিভাগকে বড় মর্যাদার আসনে দেখতে চান না। বিচার বিভাগকে কিছু দেওয়ার প্রশ্ন এলে সর্বাগ্রে তাঁদের মনে পড়ে, ওখানে তো দুর্নীতি হয়। বিচারিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রশ্ন মনে উদয় হয়। ভাবখানা এমন যে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গে এ ধরনের সমস্যা নেই। প্রশাসনের বড় কর্তারা যখন তিনটি গাড়িতে চাপেন, তখন হাইকোর্টের জজরা লক্কড়মার্কা গাড়িতে চড়েন। সুতরাং অপ্রিয় হলেও সত্য যে বিচারকদের যথাযথ শানশওকত দিয়ে উঁচু আসনে বসানোর মানসিকতা এখনো সমাজে তৈরি হয়নি।
মাসদার হোসেন মামলার রায় ছিল, বিচারকদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা যাবে না। তাঁরা পাবলিক সার্ভেন্ট নন। সংসদ যেভাবে সার্বভৌম রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুশীলন করে, বিচার বিভাগ সেভাবে প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। প্রজাতন্ত্রের সামরিক ও বেসামরিক আমলারা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অধীন, আজ্ঞাবহ। কারও না কারও অধীনে। চেইন অব কমান্ড তাঁরা মানেন। তাঁদের প্রত্যেকের বস আছেন। বসের হুকুম তাঁদের তামিল করতে হয়। কিন্তু বিচারকেরা কারও হুকুমের গোলাম নন। তাঁদের কাছে কোনো টেলিফোন আসে না। প্রধান বিচারপতি সব বিচারকের প্রশাসনিক বস মাত্র। তাই বলে বিচারাধীন বিষয়ে নবীনতম বিচারকের কাছেও টেলিফোন করার কোনো সুযোগ তাঁর নেই। যে তরুণ এই সেদিন জজিয়তিতে ঢুকেছেন, তাঁর বস হলো আইন ও বিবেক।
বিখ্যাত অল ইন্ডিয়া জাজেস অ্যাসোসিয়েশন মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়টি প্রকারান্তরে দাঁড়ি-কমাসুদ্ধ গ্রহণ করেছেন আমাদের সুপ্রিম কোর্ট। ওই রায়ে বলা আছে, আইনসভার সদস্য ও নির্বাহী বিভাগের মন্ত্রীরা যেভাবে পাবলিক অফিসে বহাল হন, সেভাবে বিচার বিভাগে জেলা জজরাও বহাল হন। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের তিন ধরনের লোক মর্যাদায় সমান। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও জজ। ‘সমতার প্রশ্ন উঠলে তা হবে রাজনৈতিক নির্বাহী, সংসদ সদস্য ও জজদের মধ্যে। সমতার প্রশ্ন জজ ও প্রশাসনিক নির্বাহীর মধ্যে তুলনীয় নয়।’
সেই প্রাচীন আমল থেকে রাষ্ট্রীয় আচারে বিচারপতিদের বিশেষ মর্যাদার আসনে রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬১ সালের আগ পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগের ওপর রাখা হয়নি। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রিসিডেন্সে সামরিক আমলাদের প্রাধান্য ছিল, এখনো আছে। সেটি ফেলে ১৯৭২ সালে আমরা নতুন বিধান করি। তবে বাংলাদেশে জজ তো বটেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী মনে করা হয় সচিব ও জেনারেলদের। মূলগতভাবে এই ভাবনা সামরিক শাসনের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। তাই সব মৌসুমে মহা প্রতাপশালী হলেন সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দুই প্রতিভূ সচিব ও জেনারেল। ভারতের শীর্ষ ২২ ভিআইপির মধ্যে সামরিক বাহিনীর কেউ নেই।
বর্তমানে বলবত্ ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ও চিফ অব স্টাফের অবস্থান ১২-তে। অথচ সংসদ সদস্য আনলাকি থার্টিনে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সচিবের ওপরে সংসদ সদস্য। এই রাষ্ট্র কাকে কীভাবে দেখে তা বোঝার জন্য এই নির্দেশক কি যথেষ্ট নয়? এই রাষ্ট্রের যেমন স্বভাব-চরিত্র তেমনি হবে এর প্রটোকল।
ভারতে সিইসি, সিঅ্যান্ডএজি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিচে তিন বাহিনীর প্রধান। বাংলাদেশে সিঅ্যান্ডএজি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের ওপরে তিন বাহিনীর প্রধান। অবশ্য বাংলাদেশের মতো ভারতেও সংসদ সদস্যরা তিন বাহিনীর প্রধানের নিচে। হাইকোর্ট বিভাগ কিসের ভিত্তিতে রায় দিলেন তার একটা ধারণা পেয়েছি। তাঁরা সব পদ-পদবিকে মোটা দাগে তিনটা ক্যাটাগরিতে ফেলেছেন। প্রথমত, সব সাংবিধানিক পদ। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, সংবিধানে স্বীকৃত ও উল্লিখিত। তৃতীয়ত, সংবিধানে উল্লিখিত কিন্তু স্বীকৃত নয়। জেলা জজদের স্বীকৃত ও উল্লিখিত এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের শুধু উল্লিখিত বিবেচনায় নিয়েছেন হাইকোর্ট। জেলা জজ বলতে যে অতিরিক্তি জেলা জজদেরও বোঝাবে, সে কথা সংবিধানে নির্দিষ্ট করে বলা আছে। আর বিচারকর্ম বিভাগে মুখ্য বিচারিক হাকিম ও মুখ্য মহানগর হাকিমের পদে জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকেরাই বহাল হন। তাই তাঁদের জন্য সমক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ঠিক এভাবে শ্রেণীবিভাগ করা এবং তার ভিত্তিতে ক্রমনির্ধারণ কতটা সংগত তা আমাদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ ও ‘বিচারকর্ম বিভাগ’-এর সংজ্ঞা সংবিধান দিয়েছে। এটা বিবেচনায় নিলে কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে বেসামরিক-সামরিক আমলারা কী করে আমাদের বিচারকর্ম বিভাগকে এতকাল কার্যত উপেক্ষা করে এসেছে। সংবিধান বলছে, বিচারকর্ম বিভাগের অর্থ ‘জেলা বিচারক পদের অনূর্ধ্ব কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কর্মবিভাগ’। আর প্রজাতন্ত্রের কর্ম অর্থ ‘অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকারসংক্রান্ত যেকোনো কর্ম, চাকরি বা পদ’।
একই মায়ের এক সন্তান বিসিএস (বিচার) হিসেবে পিএসসির পরীক্ষা দিয়ে ঢুকল, আরেক সন্তান একই যোগ্যতায় বিসিএস (প্রশাসন) হিসেবে ঢুকেছে। আগের সন্তানের ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ জেলা জজ। আরেক সন্তানের ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ সচিব। জেলা জজরা উপযুক্ত স্কেল-বৈষম্য দূর করতে মামলা করেছিলেন। এর পরিণতিতে মিলল বিচার বিভাগ পৃথক্করণ। আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের প্রতি ইদানীং দারুণ কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রতারণা তারা করছেই।
ভারত ও পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা জজদের বেতন শতভাগ, দুই শ ভাগ বেড়েছে। আমাদের আপিল বিভাগ বললেন, জেলা জজদের অন্তত ১ নম্বর গ্রেড দিতে। তাঁদের জন্য পে-কমিশন হলো। তাতে ডাকসাঁইটে আমলারা ছিলেন। জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের অনেকে ছিলেন। তাঁরা রিপোর্ট দিলেন, স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করো। আমরা দেখলাম, সরকার বিনা বাক্য ব্যয়ে তা নাকচ করল। গত ৮ ডিসেম্বরের একটি আদেশের কথা বলি। নবনিযুক্ত, বিদায়ী ও তাঁর আগে অবসর নেওয়া প্রধান বিচারপতিসহ ১১ বিচারপতির সই আছে এতে। সেখানে লেখা, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম বলেছেন, জুডিশিয়াল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদের বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের ১ নম্বরের চেয়ে কম হওয়া উচিত নয়। সরকারকে তিনি এটা বলবেন। এ কথা ভেস্তে গেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি সময় নিয়েছেন সরকারি সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে।
জেলা জজদের পদমর্যাদা যুগ্ম সচিবের নিচে হওয়া উচিত নয়, এমন অভিমত পঞ্চম সংশোধনীখ্যাত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দিয়েছিলেন আরেক রায়ে। আপিল বিভাগে তা টিকেও গেছে। বর্তমানে জেলা জজরা ৩ নম্বর গ্রেডে অর্থাত্ যুগ্ম সচিবদের স্কেলে বেতন পান। জেলা জজদের মধ্যে কিছু জ্যেষ্ঠ বিচারক বহু বছর অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় বেতন পেতেন। বিগত জোট সরকার তা খর্ব করে। তো একটি সরল প্রশ্ন—একই যোগ্যতা ও মেধাসম্পন্ন হয়ে জেলা জজরা কি পাপ করলেন যে তাঁদের জীবনে ১ নম্বর গ্রেড নিষিদ্ধ থাকবে? আরও একটি পরিহাস হলো, সংস্থাপন ও প্রশাসন ক্যাডারের লোকেরা বলে থাকেন, জেলা জজরা তো উপসচিব। তাঁরা আবার সচিব পদে বসবেন কী করে।
অথচ প্রজাতন্ত্রের প্রকৃত বিচারিক ক্ষমতা কেবল তাঁদের ওপরই ন্যস্ত। কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো শাস্তি হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগ দিতে পারেন না। উচ্চ আদালত বড়জোর ছয় মাস কাউকে জেল দিতে পারেন। তাই সকল অর্থে বিচারের সার্বভৌমত্বের কার্যকর অনুঘটক জেলা জজরাই।
হাইকোর্ট দুই মাসের মধ্যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে বাধা দেখি না। না হলে একটি কমিটি করা যেতে পারে। এম হাফিজ উদ্দীন খান জেলা জজদের খাটো করে রাখার যথার্থই নিন্দা করেন। তবে তাঁর শঙ্কা, এটা আইন মন্ত্রণালয়ে সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি হলো, উপসচিব থেকে আইনসচিব পর্যন্ত সবাই জেলা জজ। আইনসচিব হিসেবে পদায়ন করা হয় মাত্র। এটা পদোন্নতি নয়। তা ছাড়া সংবিধানের আদি ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হলে আইনসচিব পদে বা আইন মন্ত্রণালয়ে জেলা জজরা কেন যাবেন সে তর্কের অবসান ঘটবে।
আরও অনেক আইন ও রেওয়াজের মতো ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সও একটি খাঁটি বিলেতি আমদানি। হাজার বছর আগের ব্রিটেনের অ্যাংলো-স্যাকসোন দলিলে এর উল্লেখ দেখি। ১৫৩৯ সালের হাউস অব লর্ডস প্রিসিডেন্স অ্যাক্ট ব্রিটেনে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় এটিই অন্তত উপমহাদেশে প্রথম বলে মন্তব্য করেন আলোচ্য মামলার আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের একটি হালনাগাদকরণ অবশ্যই দরকার। ফিল্ড মার্শাল মানেকশর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সেনা কর্মকর্তাদের হাজিরা খুব কম ছিল। কারণ ফিল্ড মার্শাল পদ নাকি ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে ছিল না।
এর হালনাগাদকরণ অবশ্যই আলাপ-আলোচনার দাবি রাখে। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত নয়। তবে বাংলাদেশের জেলা জজরা বহু ক্ষেত্রে প্রিসিডেন্সের ২৪ ক্রমিকে থাকার বাস্তব যন্ত্রণা টের পান। এটুকু বুঝি যে, আকবর আলি খানের বর্ণনামতে অন্তত বঙ্গভবনে দাওয়াত খাওয়ার আশায় জেলা জজরা রিট করেননি! এখন ২৫-৩০ বছর পার করে তবেই একজন জেলা জজ হন। আর তাঁদের সমকক্ষ হলেন ডিসি, উপসচিব ও লে. কর্নেল। ডিসির পরে জেলা জজদের নাম মুদ্রিত। কেন? ইংরেজি বর্ণ অনুযায়ী ডিসির পরে ডিজে আসে!
গতকাল হাইকোর্টের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। আলোচ্য রিট মামলায় রাষ্ট্রের আইনজীবী নিয়োগের রীতিটা বেশ অভিনব। মন্ত্রিসভা সচিব এবং সংস্থাপন সচিব প্রাইভেট আইনজীবী নিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের ওপর হয়তো ভরসা পাননি। কারণ প্রিসিডেন্সে সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলের মর্যাদাও সংগতিপূর্ণ নয়। তাঁর অবস্থান মন্ত্রিসভা সচিবের নিচে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.