সমাপনী-প্রগাঢ় হলো রবীন্দ্রবন্ধন by জাহীদ রেজা নূর

ছিমছাম টানটান এক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠান ছিল এটা। আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে। গত বছরের ৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানমালার সমাপ্তির ঘোষণা এল মঞ্চ থেকে। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনও হয়ে গেল।


বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সকাল ১০টায় নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের উপস্থাপনায় প্রথমে বক্তব্য দেন সংস্কৃতিসচিব সুরাইয়া বেগম। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের বক্তৃতার পর অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বক্তব্য দিলেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘বাংলাদেশে আসা আমার কাছে সব সময়ই আনন্দের। একজন বাঙালি হিসেবে এটি সত্যিই একটি সুন্দর ঘরে ফেরার অভিজ্ঞতা। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী যৌথভাবে উদ্যাপন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি নিশ্চিতভাবে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে।’ তিনি আরও বললেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ এক অনন্য বন্ধন ও বিশেষ সম্পর্কের অংশীদার। আমরা সীমান্ত দ্বারা বিভক্ত হতে পারি, কিন্তু অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, নীতি ও মূল্যবোধের এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশার বন্ধনে আবদ্ধ।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় রবীন্দ্রকাব্য থেকে তুলে আনলেন একের পর এক কবিতাংশ। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকে প্রথম চারটি পঙিক্ত পড়লেন। এরপর আবৃত্তি করলেন ‘এবার চলিনু তবে/ সময় হয়েছে নিকট, এখন/ বাঁধন ছিঁড়িতে হবে’ পঙিক্তগুলো উচ্চারণ করলেন কবিগুরুর শাহজাদপুর থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগের অনুভূতি প্রকাশের নমুনা হিসেবে। উদাহরণ হিসেবে এল মহুয়া কাব্য, জীবনসায়াহ্নে লেখা কবিগুরুর কবিতা ও গানের পঙিক্ত। ১৮৯২ সালে রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের দুই দেশের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনের শুরুতেই স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিলেন। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রসঙ্গে স্মরণ করলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় জনগণের সহযোগিতার কথা। বললেন, ‘প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সমস্যা থাকতেই পারে, কিন্তু তা সমাধান সম্ভব।’ অনুষ্ঠানের সভাপতি তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এ পর্বের সমাপ্তি হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্বে ছিল কবিতা, গান ও দুটি বক্তৃতা।
বাংলাদেশের আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ ও বিষ্ণু দের ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতা দুটি আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রভারতীর সাবেক অধ্যক্ষ পবিত্র সরকার এরপর ‘হে মহাজীবন, হে মহামরণ’ শিরোনামে রবীন্দ্র-বক্তৃতা দেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বাঁচো সকলের সঙ্গে, একা বাঁচার কোনো অর্থ নেই...স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে’। মৃত্যুকে সহজে আলিঙ্গন করে নেওয়ার প্রসঙ্গটিও এল তাঁর ডাকঘর নাটকের মাধ্যমে। নাৎসি-শিবিরের ভয়ানক নৃশংসতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে পোল্যান্ডের একটি অনাথ আশ্রমের পরিচালক ইয়ানুস কোর্কজাক কী করে অনাথ শিশুদের মৃত্যুভয় দূর করেছিলেন ডাকঘর নাটকের মাধ্যমে সে বর্ণনায় সত্যিই জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান ঘুচে গেল। পবিত্র সরকারের পর ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’ গানটি গাইলেন বাংলাদেশের শিল্পী অদিতি মহসিন। এরপর রবীন্দ্র-পরিবারের শর্মিলা ঠাকুর এলেন মঞ্চে। বাঁশি নিয়ে তাঁর ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতায় যথাযথ সংগত করলেন গাজী আবদুল হাকিম। শর্মিলা ঠাকুর আবৃত্তির আগে বলেন, ‘প্রতিবছর আসবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। কিন্তু সার্ধশত বছরে যুক্ত, যৌথ যে আয়োজন সেটা আর ফেরত আসবে না। আমি কৃতজ্ঞ। নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি।’ এরপর রবীন্দ্র-বক্তৃতা দিলেন বাংলাদেশের অধ্যাপক ফখরুল আলম। তিনি ইংরেজিতে বললেন। তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড ইকো-কনশাসনেস’। ভারতের অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ’ গানটি। সবশেষে ছিল তামান্না রহমান ও তাঁর দলের নাচ। ‘ওই মহামানব আসে’ ও কয়েকটি কবিতাংশ নিয়ে তিনি তৈরি করলেন রবীন্দ্র-আবেশ। শুরুতেই বলেছি, ছিমছাম পরিপাটি ছিল এই অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথের স্পর্শ যেন পেল দর্শক বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে বসে। সে স্পর্শে আরও প্রগাঢ় হলো রবীন্দ্রবন্ধন।

No comments

Powered by Blogger.