অসহায় অর্থমন্ত্রীর স্বীকৃতিঃ সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট বেশি শক্তিধর!

বাজার নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে সরকার বিস্তর ঢাকঢোল পেটালেও হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে নিয়ন্ত্রণের লাগাম। ব্যর্থতার দায় এড়াতে একের পর এক অজুহাত খাড়া করার প্রয়াসও লক্ষ্য করা গেছে। এতদিন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল, বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বাজারে তাদের আধিপত্য বিস্তার করছে।

তারা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে চাঙ্গা করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। অথচ সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাজার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এও বলা হয়েছে, যদি সিন্ডিকেট থেকেও থাকে সরকার তার শিকড়-বাকড় তুলে ফেলবে এবং শিগগির বাজারদর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। আসেনি, বিশেষত চাল, ডাল, তেলসহ খাদ্যপণ্যের বাজার হু হু করে বাড়ছে। এই বাস্তবতায় কার্যত ফেটে গেছে পেটানো ঢাকের ছাউনি। প্রবাদ আছে, বোয়ালের ডিম বোয়ালে ভাঙে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সে কথাই প্রমাণিত হলো। তিনি বলেছেন, নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের কব্জায়। সাহসের সঙ্গে এই সত্য প্রকাশের জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু এই উপলব্ধির পরও তার সংশয়ের ধোয়াশা কাটেনি। তিনি নিশ্চিত নন যে, কীভাবে, কারা, কোথায়, কবে থেকে সিন্ডিকেট করে বাজার সরকারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তিনি কিছুটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই বলেছেন, বাজার কোনো না কোনোভাবে সিন্ডিকেটের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী একজন প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত। তিনি সিন্ডিকেটের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত না থাকলে কিংবা সক্রিয় গোয়েন্দাবাহিনীসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিতরা তাকে এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে না পারলে তো একথা বলাই যায় যে, সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট বেশি শক্তিধর। তারা সরকারের গাফিলতি কিংবা সদিচ্ছার অভাবের সুযোগ নিয়ে বাজারে রাজ্যপাট বিছিয়ে বসেছে। চালের বর্তমান আক্রা বাজার সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী দায় চাপিয়েছেন ‘বুধোর ঘাড়ে।’ তিনি পষ্ট বলে দিয়েছেন, এটা স্বীকার করতেই হবে, এ দেশের বাজারটা এখন মনোপলি ইকোনমিক সিস্টেম ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যার উত্কৃষ্ট প্রমাণ আমাদের চালের বাজার। এ থেকে বোঝা গেল, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ যথেষ্ট থাকলে বাজার স্থিতিশীল থাকার যে অর্থনৈতিক সূত্র তা আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে সত্য নয়। আমাদের সরকারের অপারগতা এতটাই প্রকট যে, চালের সরবরাহ ও মজুত যতই থাক দাম বাড়বে এবং তার জন্য সরকার কোনো দায় নেবে না। দায় নিতে হবে সিন্ডিকেটকে। কথাটা দাঁড়াল এরকম, চোর নিত্য রাতে চুরি করে যাবে। অভিযোগ করা হলে পুলিশ জানাবে—চুরি তো আমি করিনি, চোরকে জিজ্ঞেস করুন।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁও হোটেলে ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি’ শীর্ষক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও অভিনব চমক সৃষ্টি করেছেন। তার বক্তব্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অক্ষমতার আভাস দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতদিন বাজারদর প্রসঙ্গে সরকার থেকে বলা হয়েছে : যে কোনো মূল্যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এজন্য বহু বিচিত্র আয়োজনও হয়েছে। টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, পুলিশ-র্যাব বাজার তদারক করেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাজারে টানিয়ে রাখার বিহিত হয়েছে কিন্তু গর্তের মাটিতে গর্ত ভরেনি। অর্থমন্ত্রী সেসব ব্যর্থতার উল্লেখ না করে সিন্ডিকেটের পিণ্ডি চটকেছেন এবং বিস্ময়করভাবে স্বর বদল করে যা বলেছেন তার শানেনুজুল হচ্ছে, বাজারের লাগাম সিন্ডিকেটের কব্জা থেকে সরকারের কব্জায় আনতে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। অর্থাত্ সরকার আর পারছে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যান্য অবনমিত খাত চাঙ্গা করার বেলায়ও তিনি আবার সেই বাজারচলতি আশার কথাই প্রকাশ করেছেন। এমনকি বিরোধী দলকে আহ্বান করেছেন এই বলে যে, তারা যেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি না করেন। এরপর আর বলার অবকাশ থাকে না যে, সরকার তথা অর্থমন্ত্রী কথা ও কাজে মিলন ঘটাতে না পেরে কতটা বেকায়দায় পড়েছেন। অর্থাত্ সিন্ডিকেট নামক এক অদৃশ্য শক্তি সরকারকে কলা দেখিয়ে বাজার দখল করেছে, তা আবার ফলাও করে অসহায়ের মতো স্বীকার করছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। এখন এই অক্ষমতার দায় মেনে নিয়ে তিনি পদত্যাগ করবেন কিনা সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। তাতে অন্তত সিন্ডিকেটের মতো অপশক্তি সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠার ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি থেকে দেশ নিস্তার পাবে।

No comments

Powered by Blogger.