স্মরণ-টি আলী স্যার : আলো ছড়িয়ে গেছেন

টি আলী স্যার শিক্ষাকেই ব্রত করেছিলেন। স্কুলটাকে করেছিলেন তপস্যার কেন্দ্র। ছাত্রদের করেছিলেন সন্তানতুল্য। আর এ ব্রতটাকে বাস্তব করতে নিজের সংসার, স্ত্রী-সন্তানকে প্রায় ত্যাগ করতে হয়েছিল গুণী এই শিক্ষাগুরুকে। ছয় সন্তানের মৃত্যু হয়েছে প্রায় চিকিৎসা ছাড়াই।


ছেলেমেয়ের প্রতি তাঁর অবহেলার কারণে এমনটা হয়নি, হয়েছে সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে হবিগঞ্জের দূরত্বের কারণে। এখন এ দূরত্ব খুব বেশি না হলেও যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন এটুকু দূরত্ব পেরোতেই লেগে যেত দিনের পর দিন। ছয় ছেলেমেয়ে অসুস্থ হওয়ার খবর হবিগঞ্জ পেঁৗছতে পেঁৗছতে তারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। অনেকের দাফনেও শরিক হতে পারেননি এই হতভাগ্য বাবা। কিন্তু এত কিছুর পরও স্কুলের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি। বুকে পাথরচাপা দিয়ে, স্কুলের অসংখ্য ছাত্রকে নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন বছরের পর বছর। বিলিয়ে গেছেন শিক্ষার আলো। নিজের বুকে চেপে রাখা দুঃখগাথা টি আলী স্যার কখনো কাউকে বলতেন না। স্যার হবিগঞ্জ স্কুলের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন, সবাই তাঁকে হবিগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা বলেই জানতেন। স্যারের বাড়ি যে বিয়ানীবাজারে, তাঁর পরিমণ্ডলের বেশির ভাগ লোকের কাছেই এটা ছিল অজানা। বাস্তবে তিনি ছিলেন সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বৃহত্তর জলঢুপের কালাইউড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি হবিগঞ্জ সরকারি স্কুলে যোগ দেন ১৯৪৭ সালে। দুই যুগের বেশি সময় পার করে দেন স্কুলের মুসলিম হোস্টেলে। তিনি ছিলেন এই হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট। ছাত্রদের ওপর স্যারের কড়া নজরদারি ছিল। হোস্টেলে অনেকেই রাত জেগে গল্প-গুজব করত। স্যার এটা মোটেই পছন্দ করতেন না। রাত ১০টা সাড়ে ১০টার পর বারান্দা দিয়ে টহল দিতেন। কোনো রুমে আড্ডা দেখলে মেইন সুইচ অফ করে দিতেন। পরীক্ষা থাকলেও স্যার কাউকে বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে দিতেন না। খেলাধুলার ক্ষেত্রে বাধা ছিল না। তবে পড়া ফেলে খেলার কোনো সুযোগ ছিল না। আলাদাভাবে প্রত্যেক ছাত্রের পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন। স্যারের বাড়তি যত্নের কারণেই হোস্টেলের ছেলেরা সব সময় পরীক্ষায় ভালো ফল করত। হালকা-পাতলা গড়নের টি আলী স্যার বেশির ভাগ সময় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরতেন। তাঁর পায়জামাগুলো ছিল অনেক ঢোলা। দুদিকে দুটো পুকুরের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত ধীরপায়ে স্যার হোস্টেল থেকে স্কুলে আসতেন। তাঁকে আসতে দেখলেই আর কাউকে বারান্দায় দেখা যেত না। স্যার কখনো চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। স্যার পুরো সময়টা বরাদ্দ রাখতেন শুধু ছাত্রদের জন্য। ছাত্ররাই ছিল তাঁর প্রাণ। ছাত্রদের নানা সমস্যা সমাধানে তিনিই এগিয়ে আসতেন সবার আগে। কোনো ছাত্রের সমস্যা নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে যেতে হলে টি আলী স্যারই ছিলেন প্রধান অবলম্বন। ছাত্রদের হয়ে সব সময় তিনিই ওকালতি করতেন। স্যার হোস্টেলের সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়তেন। ইমামতি করতেন নিজে। বেশির ভাগ সময় সুরা 'আর রাহমান' পড়তেন। সুরা আর রাহমানের এত সুন্দর তিলাওয়াত খুব কম লোকের কণ্ঠেই শোনা যায়। ফজরের নামাজ ছেলেরা নিজেরাই পড়ে নিত। জোহর ও আসর পড়া হতো স্কুলের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে। মাগরিব ও এশার নামাজ পড়তে হতো স্যারের সঙ্গেই। ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।
টি আলী স্যার তাঁর শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতির শিক্ষাও দিতেন। নিজে গান শেখাতেন। আমাদের মধ্যে সুবীর নন্দী সম্পর্কে স্যারের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, তুমি একদিন বড় শিল্পী হবে। হোস্টেল ও স্কুলের নানা অনুষ্ঠান আয়োজনে টি আলী স্যারই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। নিজে উপস্থিত থেকে মহড়া করাতেন। তাঁর একান্ত চেষ্টায় অনুষ্ঠান সফল হয়ে যেত। স্কুলে টি আলী স্যারের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার কাছে স্যারের মতামত খুব গুরুত্ব পেত। স্যারের একটা অসাধারণ গুণ ছিল, তিনি মানুষকে দারুণভাবে উদ্দীপিত করে তুলতে পারতেন। সব সময় ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল। এ গুণটি তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, জীবিনদর্শন সব কিছুর ক্ষেত্রে স্যারের অবস্থান ছিল খুব পরিচ্ছন্ন। স্যারের অবস্থান ছিল সেক্যুলার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। খাঁটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখতে চাইতেন নিজের পরিমণ্ডলে। শিক্ষক হিসেবে ও মানুষ হিসেবে দিতেন বেহিসাবি। বিনিময়ে কী পেলেন বা পাবেন, সে চিন্তা কখনো করতেন না। স্যার আজ আমাদের মাঝে নেই। তবু ৩০ এপ্রিল তাঁর ৯৮তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা। স্যারকে উপলক্ষ করে শ্রদ্ধা জানাই দেশের এবং এই বিশ্বের সব শিক্ষককে। টি আলী স্যারের মতো শিক্ষক আমাদের সমাজে আরো আসুন। আসতেই থাকুন।

লেখকবৃন্দ : সবাই টি আলীর ছাত্র

No comments

Powered by Blogger.