সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করুন-জনপ্রশাসনে সামরিক কর্মকর্তা

বেসামরিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের প্রচলন আগেও ছিল। কিন্তু এই প্রবণতার ক্রম বৃদ্ধি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। বর্তমান সরকারের গত এক বছরে এ রকম নিয়োগ পেয়েছেন ১২২ জন, আর বিগত সরকারের আমলে পেয়েছিলেন ৮২ জন।


সামরিক বাহিনী থেকে কর্মকর্তাদের এমন ব্যাপক হারে বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ, জনপ্রশাসনে ওই সব পদে নিয়োগ পেতে হয় প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে এবং এখানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধি রয়েছে। হঠাত্ উচ্চপদে যখন বাইরে থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন প্রশাসনের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে এবং নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়। পদোন্নতি বিলম্বিত হওয়া ছাড়াও মানসিক পীড়া তাঁদের কাজের গতি নষ্ট করে। এতে প্রকারান্তরে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
সামরিক শাসনের সময়ই এ ধরনের নিয়োগ বেশি হতো। কিন্তু এখন সামরিক শাসনের অবসান হওয়া সত্ত্বেও সেই পুরোনো ধারা চলতে থাকায় প্রশাসনে হতাশা একটি নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
উপরন্তু প্রশাসনের সর্বস্তরেই ‘এরা আমাদের’ আর ‘ওরা বাইরের’ মনোভাব মজ্জাগতভাবে বিরাজ করে। এ ধরনের মনস্তত্ত্বকে সমর্থন করার কোনো কারণ নেই, কিন্তু এটাই এখন বাস্তবতা। আরেকটা তিক্ত বাস্তবতা হলো, জনপ্রশাসনের এক ক্যাডার থেকে অন্য ক্যাডারে প্রেষণে বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
এটা ঠিক যে দক্ষতা ও যোগ্যতার বিচারে প্রশাসনের কোনো কোনো পদে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের একটি ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। যেমন, আইজি প্রিজন পদে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। কোনো কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক পদেও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নিয়োগ একটি প্রচলিত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রদূত পদে সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ তো এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর পরও যখন এনএসআই, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), চা বোর্ড, বিমান থেকে শুরু করে এমনকি সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) মতো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে ঢালাওভাবে সামরিক কর্মকর্তাদের আনা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে, জনপ্রশাসনে কি দক্ষ কর্মকর্তার সংকট আছে!
রাজনৈতিক আনুকূল্য লাভ বা সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের ঘটনা কম নয়। যে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের সবাই যে সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা ও উপযুক্ততার প্রমাণ দিয়ে থাকেন, তাও নয়। তাই এসব নিয়োগ আর প্রশ্নাতীত থাকে না।
জনপ্রশাসনে সামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ অপরিহার্য হলে তা করা যেতে পারে কেবল দক্ষতা ও উপযুক্ততার বিচারে এবং দেশের প্রয়োজনে। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁদের নতুন কর্মক্ষেত্রে আত্তীকরণ করা প্রয়োজন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ রকম প্রথা রয়েছে। অনুরূপভাবে একই বিবেচনায় কিছু সামরিক পদেও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার বিধান থাকবে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের যে বিধান রয়েছে, তা বদলিয়ে এই বিবেচনার আলোকে নতুন নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.