মানবকল্যাণে প্রভু জগদ্বন্ধু by সুবল চন্দ্র সাহা

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্ব। তৎকালীন ভারতে একদিকে প্রাচীনপন্থিদের ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, জাতিভেদপ্রথা প্রভৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল; অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ভাবধারার নব্য শিক্ষিত উগ্রপন্থিদের বিদেশিয়ানা সমাজ জীবনে ডেকে এনেছিল বিপর্যয়। হিংসার আস্ফালন ও প্রবৃত্তির প্রাবল্যে গোটা সমাজ জীবনকে জরাগ্রস্ত ব্যাধির মতো হতাশ করে তুলেছিল।


অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও দরিদ্রতার নিষ্পেষণে জর্জরিত মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধ ভুলতে বসেছিল। ইহকাল খুইয়ে পরকাল ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়ে মাঝ দরিয়ার ডুবন্ত হতভাগার মতো মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কে শোনাবে তাদের আশার বাণী। এমনি এক যুগসন্ধিক্ষণে প্রেমের ঠাকুর পতিত উদ্ধারকারী শ্রীশ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর আজ থেকে ১৪২ বছর আগে এ ধরাধামে আবির্ভূত হন। ফরিদপুর শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন মহানাম সম্প্রদায় ও ফরিদপুরবাসী প্রভু সুন্দরের ১৪২তম আবির্ভাব উৎসবের আয়োজন করেছে। এ উৎসব ২৯ এপ্রিল থেকে ৭ মে, ২০১২ পর্যন্ত ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে উদযাপিত হচ্ছে।
প্রভু জগদ্বন্ধু ১২৭৮ সনের ১৬ বৈশাখ (১৮৭১ সালের ২৮ এপ্রিল) পবিত্র সীতা নবমী তিথিতে মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়া গ্রামে আবির্ভূত হন। তার মাতা বামা দেবী। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন। ১৭ মাস বয়সে প্রভু সুন্দরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দীননাথ ন্যায়রত্ন মুর্শিদাবাদ থেকে প্রভু সুন্দরকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর শহরের ব্রাহ্মণকান্দা গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্রাহ্মণকান্দার অদূরেই গোয়ালচামট শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন অবস্থিত। শ্রীশ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের প্রকট লীলাকাল অতি সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১৩২৮ সনের আশ্বিন মাসের ১ তারিখে তিনি লীলাসংবরণ করেন।
প্রভু সুন্দরের দিব্য জীবনের দুটি দিক রয়েছে। একটি তার আধ্যাত্মিক দিক, অপরটি সমাজের পিছিয়ে পড়া বুনা, বাগ্দী, ডোম এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উদ্ধারের জন্য বন্ধুরূপে প্রকাশ। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। ধর্মীয় পরিচয় তার ছিল বটে; তবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্যত্বহীন অধিকারবঞ্চিতদের মানুষের মর্যাদায় উন্নীত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তাই তিনি 'জগদ্বন্ধু'।
ফরিদপুর শহরের উপকণ্ঠে হিন্দু নিম্নশ্রেণীর বুনা, বাগ্দী, সাঁওতাল বসবাস করত। বুনাশ্রেণীর অধিকাংশ লোকই ছিল অশিক্ষিত ও কুসংস্কারপূর্ণ। মদ্যপান, গাঁজা সেবন প্রভৃতি অসামাজিক কাজ তাদের নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। নিজেদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও হিংসা-বিদ্বেষের কারণে তাদের ব্যক্তি জীবনে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রি সাহেবরা বুনা জাতির এ দুর্বলতার সুযোগে তাদের ধর্মান্তর করতে চেষ্টা করেন। গোপালগঞ্জ এলাকার অনেকেই খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেন। প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের স্নেহের পরশে বুনা জাতির মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। সুন্দরের প্রবর্তিত হরিসংকীর্তনের মাধুর্যে তাদের স্বধর্ম ত্যাগের প্রবণতা লোপ পায়।
জগদ্বন্ধু সুন্দর ফরিদপুরের বুনা, বাগ্দী কলকাতার রামবাগানের ডোমপল্লীর অসভ্য নরনারী, সোনাগাছির বারবনিতাদের উদ্ধারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বুনা, বাগ্দীদের মোহন্ত ও ডোমপল্লীবাসীর ব্রজনন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দর গোয়ালচামট শ্রীঅঙ্গনের একটি নির্জন কুটিরে মহাসত্য উদ্ঘাটনে ১৩০৯ থেকে ১৩২৫ সন পর্যন্ত একাদিক্রমে দীর্ঘ ১৬ বছর মহাধ্যানে গম্ভীরায় নিমগ্ন ছিলেন। ১৬ বছর পর ধ্যান ভঙ্গ করে বের হওয়ার পর তার হাত-পা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল।
পরিশেষে প্রভু সুন্দরের ১৪২তম শুভ আবির্ভাব উৎসবের এ পবিত্র দিনে আমরা এ শপথ গ্রহণ করি, জাতিভেদ, বর্ণভেদ আর কুসংস্কারের জঞ্জাল ঝেড়ে-মুছে ফেলে সকলকে মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে তুলব।
 

No comments

Powered by Blogger.