অব্যবস্থাপনার আরেকটি নজিরঃ শিক্ষাবর্ষের দু’মাস পরও বই নেই

অব্যবস্থাপনার আরেকটি নজিরঃ শিক্ষাবর্ষের দু’মাস পরও বই নেইবৃষ্টি দরকার, কিন্তু অকালে নয়। অকাল বর্ষণে ফসলের ক্ষতি হয়। অনেকটা এরকমই হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বেলায়। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী তার পূর্বঘোষিত আশাবাদ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

গত বছর নভেম্বর মাসে শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা নিয়ে মুদ্রণকারীরাই আশঙ্কা করেছিলেন যে, বিনামূল্যের শতভাগ বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে পুরো জানুয়ারি মাস লেগে যেতে পারে। এখন দেখা যাচ্ছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের দু’মাস অর্থাত্ ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত বই বিতরণ দূরের কথা, সবেমাত্র ইংরেজি ভার্সনের বই ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিকের জন্য বাংলা ভার্সনের আরও ৩৬ লাখ বইও ছাপা হবে। এসব বই কবে ছাত্রছাত্রীদের হাতে যাবে—এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। উল্লেখ্য, ২০০৯-এর ১৩ নভেম্বর আমার দেশ-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে আমরা সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলাম, শিক্ষামন্ত্রীর কথার যেন নড়চড় না হয়। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, সরকারি সিদ্ধান্তের জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকেই প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বোর্ডের ইংরেজি ভার্সনের বিনামূল্যের এক লাখ ৮৫ হাজার বই ছাপার কাজ শুরু হচ্ছে। একই সঙ্গে নেয়া হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের সাড়ে তিন লাখেরও বেশি বইয়ের ছাপার উদ্যোগ। অর্থাত্ মোট ৩৮ লাখ বই ছাপছে এনটিসিবি। অভিযোগ আছে, ছাপার এ কাজ আরও আগেই শুরু করা যেত। কিন্তু টেন্ডার নিয়ে ঘাপলা করায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বোর্ড কোনো টেন্ডার ছাড়াই কয়েকটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে মুদ্রণকারী সংস্থার অনেকেই মনে করছেন, এটা একটা অবৈধ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় তারা এখন পর্যন্ত বই ছাপতে রাজি না হওয়ায় ছাপার কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রাথমিকের বাংলা ভার্সনের বই ছাপার ব্যাপারে মুদ্রণকারীদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগই করেনি এনসিটিবি। প্রাপ্ত তথ্য মতে, এখন থেকে বই ছাপা শুরু হলেও বই বিতরণ করতে সময় লেগে যেতে পারে আরও প্রায় মাস দেড়েক। বস্তুত এই ঢিমেতেতলা ও অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ফলে বই পেতে যে শিক্ষার্থী অপেক্ষায় ছিল, তাদের হতাশা চরমে উঠেছে অনেক আগেই। এদিকে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী দেশের সব স্কুলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে। এ অবস্থায় বিনামূল্যের বই পেলেই বা কী হবে? তাছাড়া এরই মধ্যে উপায়ন্তর না দেখে প্রায় সব ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার কথা ভেবে বাজার থেকে বেশি দামে কিনে ফেলেছে পুরনো ও পাইরেটেড বই। শেষ পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই হিসেব কষে আশ্বাস না দেয়ায় ‘গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল’-এর মতো ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষামন্ত্রীর আরেক দফা আশ্বাস পরিণত হলো ফাঁকা কথায়। গত ৭ জানুয়ারি তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দেয়া হবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু বই ছাপানো না হওয়ায় যথারীতি শিকেয় উঠল মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। অজুহাত হয়তো তৈরি আছে, কিন্তু এই অযাচিত বিলম্বের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি। বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপিয়ে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকারের। এটি একটি জাতীয় কার্যক্রম এবং আগে গৃহীত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে একাধিকবার ঘোষণা দেয়ার এবং শিক্ষাবর্ষের প্রায় দু’মাস চলে যাওয়ার পরও বই ছাপানোর কাজই ঝুলে আছে কেন, তা কারও বোধগম্য নয়। না, এই ব্যর্থতা কোনো অজুহাত দেখিয়ে এড়ানো বা আড়াল করার অবকাশ নেই। আশ্চর্যের বিষয়, বিনামূল্যে বই সংক্রান্ত আশা-নিরাশার দোলাচল শিক্ষার্থীদের কতটা ক্ষতির মুখে দাঁড় করিয়েছে, তাদের মানসিকতায় কতটা আঘাত লেগেছে, কর্তৃপক্ষ এখনও তা অনুধাবন করতে যে সক্ষম হয়নি—অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এতসব ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তহীনতা কাটেনি। টেন্ডার নিয়ে অবৈধ তত্পরতার অভিযোগ রয়েই গেছে। সব মিলিয়ে সময়ের একফোঁড় পরিণত হয়েছে অসময়ের দশ ফোঁড়ে। এর বিহিত হওয়া জরুরি। নইলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। আপাতত আমাদের প্রত্যাশা—এবারও যেন শিক্ষামন্ত্রীর কথার নড়চড় হয়ে আরেকটি চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার দৃষ্টান্ত তৈরি না হয়।

No comments

Powered by Blogger.