অভিমত ভিন্নমত

ছাত্রলীগ এই সরকারের জন্য ছাত্রদলের চেয়েও ক্ষতিকর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে সরকারের জন্য বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।


ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য মোটেও কমছে না।
গত ২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে মেতে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ। ৩০ জন আহত হয়েছে। আর তাদের এই হানাহানির মধ্যে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন আবু বকর নামের এক নিরীহ সাধারণ ছাত্র। পুলিশ এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ নয়জনকে আটক করেছে। ১৪ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু কী হবে এঁদের? খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই বলে দিলেন, ‘এটা কোনো ব্যাপার না; এমন ঘটতেই পারে।’ হায়! কী মারাত্মক সংবেদনহীনতা! দেশের মানুষ নির্বাক হয়ে গেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন হূদয়হীন, নির্বিকার মন্তব্যে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এক বছর ধরে ছাত্রলীগ চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, হল দখল, সিট দখল নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ চালিয়েই যাচ্ছে; সরকার কেন তাদের ঠেকাতে পারছে না? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অনেকবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘সন্ত্রাস করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।’ কিন্তু ছাত্রলীগের কতজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সত্যিকারের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? কতগুলো সংর্ঘষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে আর কতজনকে গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে?
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব এই সরকারের শুরুর দিকে একবার লিখেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান।’ খুবই দরকারি পরামর্শ ছিল এটি। কারণ ছাত্রলীগই এই সরকারের ভাবমূর্তির জন্য যতটা ক্ষতিকর একটা ব্যাধির মতো হয়ে উঠেছে, ততটা আর নেই। বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এই সরকারের জন্য এতটা ক্ষতিকর নয়।
কিন্তু ছাত্রলীগকে সামলানো যাচ্ছে না! সরকার যেন অসহায় হয়ে পড়েছে! এর মাশুল সরকারকেই গুনতে হবে। আর এরকম সংবেদনহীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলে দেশের মানুষের সামনে আরও যে কত বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে। সরকারের জন্যও এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে আরও কত বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারেন, তা আমরা জানি না।
বড় আশা করে ভোট দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে; গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগকে। আশা করেছিলাম, তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের রেশ কাটিয়ে সুশাসনের পথে এগিয়ে যাবে, মানুষের অভাব-অনটন কমবে, বেকার ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে, মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে, রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। কিন্তু হায়! এসব কী দেখতে হচ্ছে? সামনের চার বছর আরও কত কী দেখতে হবে!
এ সরকারকে ছাত্রলীগকে সামলাতেই হবে। আর যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী দেশজুড়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত রয়েছেন, তাঁদেরও কঠোর হাতে দমন করাই এ সরকারের প্রধান কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনে সরকার কেবল তখনই সফল হতে পারবে যখন আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করবে যে এগুলো বন্ধ না করলে তার ভরাডুবি নিশ্চিত। কিন্তু কোনো অতীতে কোনো সরকারের মধ্যেই এমন উপলব্ধি দেখা যায়নি যে তাদের উচ্ছৃঙ্খল, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। বরং সব সরকারের আমলেই দেখা যায় জনদরদী, সত্, শান্তিপ্রিয়, ভদ্র নেতাকর্মীরা দলের মধ্যে কোনো সমাদর পান না, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা সমাদর পায় বেশি।
আসলে আওয়ামী লীগের মতো দলকে পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয় না। গত নির্বাচনে দেশের মানুষ এই দলকে ভোটের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের জবরদস্ত টাকাওয়ালা নেতাদের জন্যও নয়। জনগণ আওয়ামী লীগকে এই আশায় ভোট দিয়েছিল যে তাদের নেতৃত্বে সরকার এই দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে; খুব তাড়াতাড়ি সমৃদ্ধি আনতে না পারেন, কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের চেষ্টা করবে। জনগণ এ সরকারকে ভোট দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িকতামুখী, প্রচণ্ড দুর্নীতিপ্রবণ, সন্ত্রাসমূলক দুঃশাসনের প্রতি ধিক্কার জানাতে এবং এ সরকারের কাছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনের প্রত্যাশা নিয়ে।
কিন্তু যেভাবে দেশ চলছে, সেভাবেই চলতে থাকলে জনগণের আশাভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগবে না। আর তার পরিণতি হবে খুবই খারাপ। শুধু সরকারি দল ও তার নেতাকর্মীদের জন্য নয়; গোটা জাতির জন্যই। তাই বলি, অনেক হয়েছেআর নয়।
হোসেন লস্কর
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

গণমাধ্যমের ভাষা
১ ফেব্রুয়ারি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষা বিকাশ: কঠিনেরেই ভালোবাসতে হবে’ শিরোনামের লেখাটি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। মনে হলো, আমার ঠিক উপলব্ধিটাই ছাপা হয়েছে।
সত্যিই বাংলা ভাষা আজ অবহেলিত; নিজের দেশে, নিজের সন্তানের দ্বারাই উপেক্ষিত। কোনো বিদেশি যখন ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে, সঠিক উচ্চারণের বাংলা বলতে পারে না, তখন আমরা একটু খুশিই হই এই ভেবে যে, যাক অন্তত সে বাংলা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন কোনো শিক্ষিত বাঙালি বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, যখন কোনো তরুণ বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলে, তখন আমরা নিজেদের কীভাবে প্রবোধ দেব? কী জবাব দেব একুশের শহীদদের?
যদি বলি গণমাধ্যমের প্রভাবেই নতুন প্রজন্ম এমনভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছে, তাহলে তো এর সমাধানও খুঁজতে হয় গণমাধ্যমের কাছেই। যদি গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপক ও নীতি-নির্ধারকেরা বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি একটু দৃষ্টি দেন, একটু মনোযোগী হন এবং প্রমিত উচ্চারণে অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন, তাহলে অবশ্যই এর প্রভাব নতুন প্রজন্মের ওপর পড়বে। ভাষা বিকৃতির বেশির ভাগ দায় যদি গণমাধ্যমের ওপরই বর্তায়, তাহলে ভাষার প্রতি যত্নশীল হয়ে গণমাধ্যম ভাষার সুস্থ বিকাশেও ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ গণমাধ্যমের প্রভাব অপরিসীম। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠ্যপুস্তক, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়েও এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রভাব বেশি। গণমাধ্যমে ভাষার সুষ্ঠু-সুন্দর অনুশীলনের মাধ্যমে সারা বছর হয়ে উঠবে ফেব্রুয়ারির মহিমায় ভাস্বর।
মাকলুকা জিনিয়া
চাকলাপাড়া, ঝিনাইদহ।

মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা কেন
১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষার বিকাশ: কঠিনেরেই ভালোবাসতে হবে’ শিরোনামের লেখায় লেখক পণ্য সংস্কৃতি ও মিডিয়া সংস্কৃতির কাছে আমাদের ভাষার হেরে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে ভাষার প্রতি বিরাট অনীহার কথা উল্লেখ করেছেন। আমার মনে হয় এটা অনীহা নয়, আমাদের মানসিক দৈন্য।
মনের দিক থেকে যখন কেউ দীন-দরিদ্র হয়ে পড়ে, তখন তার নিজের পরিচয়, অবস্থান সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আমরা নিজের ভাষায় কথা বলি ইংরেজি ভাষার অনুকরণে। তার চেয়েও দুঃখজনক হলো, যাঁরা এভাবে বাংলার মধ্যে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে কথা বলেন, তাঁরা শুদ্ধ করে বাংলাও বলতে পারেন না, ইংরেজি তো নয়ই।
দুঃখ লাগে, যখন দেখি বহুজাতিক কোনো কোম্পানির অর্থায়নে কোনো টিভি চ্যানেল আমার দেশের মেয়েদের দিয়ে সম্পূর্ণ পশ্চিমা ধাঁচে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসী শিশুরা যখন এ ধরনের অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখে, তখন তারা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত হয়; এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে তারা আমাদের প্রকৃত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য খুঁজে পায় না। আসলে আমরা কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে সমৃদ্ধ। আমাদের সাংস্কৃতিক ধাঁচেই নানা ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান করা সম্ভব, যেখানে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-আচার সবকিছুর প্রতিফলন থাকবে।
বিশ্বায়নের এই যুগে উচ্চশিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইংরেজিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ভাষাও আমাদের বেশ সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা আমাদের খুব ভালোভাবে শেখা উচিত। কিন্তু সে জন্য মাতৃভাষা বাংলাকে কেন অবহেলা বা অবজ্ঞা করতে হবে? প্রত্যেক জাতিরই সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা থাকে, নিজস্ব ঐতিহ্যের মধ্যেই থাকে তার মর্যাদা ও সম্মান।
এমদাদুল হক, ঢাকা।

আলো আসবে
পিংকির আকস্মিক চলে যাওয়া দৈনন্দিন জীবনের সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও আমাকে ভাবিত করেছে। এই একুশ শতকের তুলনায় যথেষ্ট শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন করেও কেন একটা মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়? আত্মহনন কোনো সমস্যার সমাধান নয়।
যখন কোনো মেয়েকে মুঠোফোনে উত্ত্যক্ত করা হয়, তখন তাকে পরামর্শ দেওয়া হয় সিম বদলে ফেলার। কিন্তু একটি মেয়ে কতবার সিম বদলাবে? এই সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কল রিসিভ না করা। এ ক্ষেত্রে স্বজনদের জানিয়ে দেওয়া যেতে পারে অপরিচিত নম্বর থেকে কল না দিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা দেখা যায়। এ রকম ঘটনার পর অনেক শিক্ষার্থী তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন। তখন হতাশায় অনেকে আত্মহননের পথ বেছে নেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ না হয়ে ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
কোনো অঘটন ঘটলে তার জন্য প্রথমেই মেয়েটিকে দায়ী করা হয়। মা-বাবা যদি একটু ব্যতিক্রমী হন, তবে তো কোনো ক্ষতি নেই। আমিও মেয়ে। জীবন চলার পথে অনেক ঘটনা আমাকে ভীত করেছে, কাঁদিয়েছে। কিন্তু আমাকে ভাঙতে দেননি আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, বন্ধুরূপী মা-বাবা। প্রতিটি মানুষের জীবনেই মা-বাবার অবদান অনস্বীকার্য। আর কেউ হোক না হোক, অন্তত এ দুটো মানুষের জন্য ‘আত্মহনন’ শব্দটিকে অভিধান থেকে মুছে ফেলতে হবে। আত্মহননকারী মেয়েরা কেন ভুলে যায় যে নারী জীবনদানের প্রতীক, জীবননাশের নয়। তাকে বাঁচতে হবে, কারণ সে-ই বাঁচাবে আরও অনেক প্রাণ। একজন নারী পরিবারের সবার জন্য বেঁচে থাকেন, তাই পরিবারের সবাইকেও তাঁর হয়ে বেঁচে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
আমাদের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে বের করতে হবে এবং সেই লক্ষ্য পর্যন্ত যাওয়ার জন্য অন্তত চেষ্টা করতে হবে। লক্ষ্য অর্জনের পথে সমস্যা আসবেই, সমাধানও মিলবে এবং আলো আসবেই আসবে।
আদিবা ফান্নানা, টাঙ্গাইল।

শিশুদের প্রাইভেট কোচিং
আমরা শিশুদের ওপর লেখাপড়ার বোঝা যেভাবে চাপিয়ে দিচ্ছি, যেভাবে তাদের লালন-পালন করছি, তা তাদের পরিপূর্ণ মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে কতটুকু সহায়ক হবে তা কি ভেবে দেখেছি? কিছু অভিবাবক ও শিক্ষক স্কুল ও প্রাইভেট-কোচিংয়ের বাইরে শিশুদের আর কিছু করার সুযোগই দেন না (কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল গৌণ হয়ে যায়)।
এমনকি শুক্র-শনিবারেও শিশুদের প্রাইভেট-কোচিংয়ে ব্যস্ত রাখা হয়। এমনকি বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো জাতীয় উত্সবগুলোর ছুটিতেও শিশুদের কোচিং থেকে মুক্তি মেলে না। সপ্তাহের সাতটি দিনই সিলেবাসের পড়ালেখায় প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রাখা কোমলমতি শিশুদের মানস গঠনে কতটুকু সহায়ক ভাবা দরকার।
কবি সুনির্মল বসু বলেছেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।’ কিন্তু অবিরাম রুদ্ধদ্বার এই প্রাইভেট কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের সেই সুযোগ কোথায়? জীবন-জগত্-প্রকৃতি থেকে শিক্ষা না নিলে কি শিক্ষা পূর্ণতা পায়? ক্লাসের পুঁথিগত পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, ভ্রমণ, মা-বাবা-আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাহচর্য যে একটি শিশুর বিকাশে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো আমরা ভুলতে বসেছি।
দুর্নীতিসহ অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে আমাদের দেশপ্রেমের অভাব। কিন্তু এই দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে জাগানোর জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ দরকার। শৈশব থেকেই ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ আর মহান ২১শের ভোরবেলায় কান পেতে থাকতাম কখন বেজে ওঠবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’সহ সেই অমর দেশাত্মবোধক গানগুলো।
কখন ফুল নিয়ে ছুটে যাব শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ কিংবা অনুষ্ঠানস্থলে। কী যে এক শিহরণ, কী যে এক পবিত্র অনুভূতি জাগে দেশের প্রতি! একটি শিশু জীবনে যদি একটি দেশের গান না গাইল, মুক্তিযুদ্ধের একটি কবিতা আবৃত্তি না করল, স্বাধীনতার একটি নাটক না দেখল বা জাতীয় দিবসগুলোতে মানুষের মিলনমেলায় গিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলন-স্বাধীনতা-বিজয় দিবসের তাত্পর্য না বুঝল; তাহলে কী করে সে বুঝবে দেশকে আর কীভাবেই বা ভালোবাসবে?
সাত দিন চব্বিশ ঘণ্টাই শিশুদের শুধু প্রাইভেট-কোচিংয়ের মধ্যে রেখে তারা কত সুন্দর মানুষ হচ্ছে তা বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে। সতীর্থরা নির্মমভাবে পরস্পরকে খুনের নেশায় মেতে ওঠে। তারা এ দেশেরই সন্তান, তারা পরস্পর ভাই-বন্ধু-সতীর্থ—এই সবকিছুকে ভুলে যখন সহিংসতায় মেতে ওঠে, তখন নিশ্চয় বুঝতে বাকি থাকে না যে কতটা প্রেম, কতটা সৌন্দর্য আর কতটা মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়েছে তাদের মধ্যে। তাদের সহিংসতায় আজ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, গৌরবান্বিত ছাত্ররাজনীতি ভুলুণ্ঠিত। কিন্তু আমার মনে হয়, তাদের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য আমরা অর্থাত্ তাদের শিক্ষকেরাও দায়ী। আমরাই তাদের প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার মধ্যে শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় গড়ে তুলছি অতি-ব্যক্তিকেন্দ্রিক যান্ত্রিক মানুষ হিসেবে।
শিশুদের দিনের একটা সময় এবং সপ্তাহের এক দিন অবকাশ যাপনের সুযোগ দিতে হবে। এই অবকাশে তারা ছুটে যাক খেলার মাঠে, সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্রে। ঘুরে বেড়াক বন্ধু-আত্মীয়-প্রতিবেশীর বাড়িতে। নদীতে সাঁতার কাটুক, ঘুড়ি, ফড়িং আর পাখির পেছনে ছুটে বেড়াক।
তাহলেই হয়তো আমরা আজকের শিশুকে আগামীতে পাব কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সুনাগরিক হিসেবে। কারণ আজ আমাদের শুধু ভালো ছাত্র নয়, বেশি প্রয়োজন ভালো মানুষের।
প্রশান্ত কুমার বসাক
রাণীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও।

সোনাহাট স্থলবন্দরের সম্ভাবনা
দেশের অনগ্রসর জেলাগুলোর একটি কুড়িগ্রাম। এই জেলার অধিকাংশ মানুষ মূলত মৌসুমি শ্রমিক। মঙ্গাপীড়িত এই জেলার দিকে সরকার একটু সজাগ দৃষ্টি দিলে এখানকার মানুষের কিছু উন্নতি হতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য স্থলবন্দর নেই। আসাম, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর ও নাগাল্যান্ড রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা আছে। সোনাহাট ও ভারতের আসাম রাজ্যের মধ্যে স্থলবন্দর হলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য-সুবিধা বাড়ত, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতো। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ব্যাপক। এই ঘাটতি কমানোর উপায় হলো বেশি বেশি পণ্য ভারতে রপ্তানি করা। ভারতীয় সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের বেকারিসামগ্রী, আসবাবপত্র, ইলিশ মাছ, সিমেন্ট, সিরামিক, তাঁতের কাপড়, জামদানি শাড়ি, জুস, জ্যাম, জেলি, কৃষিপণ্য ইত্যাদির বেশ চাহিদা রয়েছে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় ও পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা সুবিধাজনক নয়। ত্রিপুরা থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে কলকাতায় যেতে বাস বা ট্রেনে প্রায় তিন দিন লাগে; কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তাই বাংলাদেশ থেকে কম মূল্যে কৃষিজাত পণ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব এবং এতে তারা আগ্রহী। এটা তাদের জন্য সাশ্রয়ী বটে।
সোনাহাট স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য সরকারকে নতুন করে তেমন অর্থ ব্যয় করতে হবে না। শুধু ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রাস্তাটি মেরামত করলেই যথেষ্ট। এখানকার ভূমি প্রাকৃতিকভাবে উঁচু ও সমতল। আবহাওয়া, জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, দুই পাড়ের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা একই রকম। কম মূল্যে শ্রমিক সরবরাহ ও সামাজিক সম্প্রীতি আছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ নিলেও স্থলবন্দর নির্মাণ কার্যকর হয়নি। এবার ক্ষমতায় আসার পর এই সরকার আবার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।
আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত সোনাহাট স্থলবন্দর নির্মিত হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বাড়বে, দুই হাজার শ্রমিকের জন্য স্থায়ী কাজের সংস্থান হবে। বন্দরকেন্দ্রিক বিনিয়োগ ও শিল্পসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি এবং কৃষিক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি ঘটবে। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হবে। কুড়িগ্রাম জেলা তথা উত্তরবঙ্গের মানুষের দাবি, সোনাহাট স্থলবন্দর অচিরেই চালু করা হোক।
মো. জাহাঙ্গীর আলম, কুড়িগ্রাম।

সংবিধানের সংশোধন ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই প্রণীত হয়েছে সংবিধান। তবে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর সংশোধন, পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কিন্তু বারবার সংবিধান কাটাছেঁড়া উচিত নয়, কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে তা করা হয় না। সংবিধান সংশোধনের কাজটি করতে হয় অনেক চিন্তা-ভাবনা করে, দূরদৃষ্টির সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকারের প্রজ্ঞাপন ও আদেশবলে পঞ্চম সংশোধনী আনা হয়, যা বর্তমানে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে আদালত পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কার্যক্রম ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড’বলে মার্জনা করেন। এর কারণ হিসেবে দেশে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এ রায়ের ওপর ভিত্তি করেই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা হচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র—মূলত সংবিধানের এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েই সরকার সংবিধান সংশোধনে হাত দিতে চায়। আবার সংবিধানে ‘বিসিমল্লাহির রহ্মানির রাহিম’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রাখার পক্ষেও কথা বলছে তারা। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পাওয়ায় সরকার নিজেদের ধ্যান-ধারণা মোতাবেক সংবিধান সংশোধনে তেমন বাধার সম্মুখীন হবে না, তা সহজেই অনুমেয়। তবে যেসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে চাইছে, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা যৌক্তিক তা অনুধাবন করা প্রয়োজন।
১৯৭২ সালে প্রবর্তিত মূল সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বিবৃত হয়েছিল যে ভাষাগত ও কৃষ্টিতে একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ১৯৭৯ সালে প্রবর্তিত পঞ্চম সংশোধনী অনুসারে অনুচ্ছেদটি পরিবর্তন করে সেই স্থানে দেশপ্রেমকে জাতীয় উন্নতির সব কর্মকাণ্ডের মূল অনুপ্রেরণার উত্স হিসেবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ যুক্ত করা হয়। এর পক্ষে-বিপক্ষে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা হয়তো অনেক যুক্তি দেখাবেন। বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর এই বিতর্ক জাতিকে যেমন বিভক্ত করবে, তেমনি বিশ্বের কাছেও হাস্যস্পদ করবে। জাতীয়তাবাদের বর্তমান সাইনবোর্ড স্বস্থানে রেখে বরং দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও দুর্নীতির যে কলঙ্ক এখনো জাতির ললাটে লেখা আছে, তা মুছে দেওয়াই হবে সঠিক কাজ।
তদানীন্তন বিশ্বব্যবস্থায় আবেদন সৃষ্টিকারী আদর্শ সমাজতন্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম দিকনির্দেশক হিসেবে ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতিতে স্থান পেলেও কার্যত তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্রের ধারা পুনঃপ্রবর্তন কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখার বিষয়। ’৭২-এর সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েই হয়তো বর্তমান সরকার ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা ভাবছে। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তথা সব ধরনের সন্ত্রাস নির্মূলে আইনের আশ্রয়ে কোনো বাধা নেই। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য সরকার সংবিধান সংশোধন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেই রাজনৈতিক শক্তি তখন অনিয়মতান্ত্রিক সন্ত্রাসবাদী তত্পরতায় লিপ্ত হতে পারে। সংবিধান সংশোধনে এমন কোনো বিষয় আনা ঠিক হবে না, যা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে, মানুষের নিরাপত্তা কমে যায়।
শাহীন আরা
কমলাপুর, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.