চারদিক-‘সাউ কালে অন্ধ হইছি’ by মনিরুল আলম

আমার মোটরসাইকেলটি যানজটের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে। একদিকে প্রখর রোদ আর অন্যদিকে অসহনীয় যানজট। কিন্তু কিছুই করার নেই। এই যানজট ঠেলেই আমাকে যেতে হবে গন্তব্যে। নগরবাসীর এ এক বিড়ম্বনা। অনেকটা বাধ্য হয়ে নীরবে সব কিছু সহ্য করতে হয়। কেউ কেউ এর প্রতিবাদ করেন, কিন্তু সেটা সাময়িক।


এর যেন কোনো স্থায়ী সমাধান নেই।
যানজটে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, একটা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে চলছে ক্রমাগত। দীর্ঘ যানজট এড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই যানজট ঠেলে এগিয়ে যেতে পারছে না। আর পথচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে নেই কোনো উদ্যোগ। আগে দেখতাম, এই বিষয়গুলোতে মানুষ অনেক অনেক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। এখন ঠিক তার উল্টো চিত্র। যেন নিজেকে নিয়েই বাঁচা—নিজের জন্য বাঁচা।
আমার গন্তব্য কেরানীগঞ্জের রোহিতপুরের সোনাকান্দার সৈয়দপুর ঘাট। ধলেশ্বরী নদীর বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, এ রকম একটি খবর পেয়েছিলাম। সেই ছবি তুলতে যাচ্ছিলাম।
বাবুবাজার ব্রিজের ওপর পিঁপড়ার সারির মতো দাঁড়িয়ে আছে শত শত বাস। এরা মাওয়া ফেরিঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছে। গন্তব্য গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড, কিন্তু কোনো উপায় নেই, যানজট ঠেলেই যেতে হবে। হঠাৎ দেখলাম, একজন নারী যাত্রী বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে বমি করতে শুরু করেছেন। আর যায় কোথায়, আশপাশের যত পথচারী দে ছুট! বাসে বসে থাকা বেচারি যাত্রীটি কাহিল, খুব সম্ভবত দীর্ঘ যাত্রা আর গরমের কারণে তাঁর এই অসুস্থ হয়ে পড়া।
বাবুবাজার ব্রিজ পেরিয়ে আমি এখন কেরানীগঞ্জের পথে। আমার মোটরসাইকেলটি রীতিমতো লাফাতে শুরু করল। এ আর এক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা মোটরসাইকেল চালান যাঁরা, তাঁদের কমবেশি আছে। অর্থাৎ সড়কের দুরবস্থা। জায়গায় জায়গায় ভাঙা। কোথাও কোথাও আবার বড় বড় গর্ত। এসব গর্তে গাড়ির চাকা পড়লে রীতিমতো স্প্রিংয়ের মতো গাড়ি লাফাতে লাফাতে চলতে থাকে। এই অবস্থায় বেচারা যাত্রীদের দফারফা। মনে মনে ভাবলাম, এ রকম অবস্থা যদি পুরো সড়কের হয় তাহলে শরীরের ব্যথায় ওই যাত্রীর দুই দিন বাড়িতে শুয়ে থাকতে হবে।
এ রকম সময় মানুষটাকে দূর থেকে দেখলাম! একটা থালা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। প্রথমে বুঝতে পারিনি, তারপর আরও কাছে যেতেই বুঝলাম, তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।কেরানীগঞ্জ জেলা সড়কের নেকরোজ বাগ সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ভিক্ষা করছেন। সেখানে একটা কবরস্থান রয়েছে, নাম দশগ্রাম কবরস্থান। নির্দিষ্ট একটা সীমানার মধ্যে একবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছেন, আবার আসছেন। আর ওই সড়ক দিয়ে যথারীতি বাস, ট্রাক, টেম্পোসহ নানা ধরনের যান চলাচল করছে। মোটরসাইকেল থামিয়ে দেখতে থাকলাম, উনি কী করেন। হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত হলাম, তিনি এভাবেই হাঁটাচলার মধ্য দিয়ে ভিক্ষা করছেন। এটা রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা, আর যে সড়কটিতে তিনি ভিক্ষা করছেন, সেখানে মানুষের চলাচল কম। তাঁর সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ বেড়ে গেল।
এই যে ভাই, আপনার নাম কী? আপনি এইভাবে ভিক্ষা করেন কেন? গাড়িচাপা পড়লে? আপনার সাদাছড়ি নাই?
—একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন শুনে লোকটা আওয়াজের উৎস খুঁজতে লাগলেন এবং ঠিক ঠিকই উৎস অনুযায়ী এগিয়ে এলেন।
—আমার নাম বাবা, জাহিদ হোসেন। আমি সাউকালে (ছোট সময়ে) টাইফয়েডে পড়ে অন্ধ হইছি। আমি এইভাবেই হাঁটাহাঁটির মধ্যে ভিক্ষা করি। আমার কোনো সাদাছড়ি নাই, আর ভিক্ষা না করলে আমি আমার পরিবাররে কী খাওয়াতাম, আপনে কন দেহি।
আপনার পরিবারে কে কী করে?
—আমার বউ বাড়ির কাম-কাইজ করে আর এক ছেলে অনিক ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আর মাইয়ায় পড়ে ক্লাস সিক্সে। ওরা বড় হইলে আমার আর ভিক্ষা করতে হইত না।
বুড়ো ভদ্রলোক স্বপ্ন দেখছেন, কোনো একদিন তাঁর সন্তানেরা বড় হয়ে তাঁকে ভিক্ষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু এই স্বপ্ন ভাঙা আর যানজটে স্থবির রাস্তার মতো কি না, সে প্রশ্ন জেগেছিল আমার মনে।
কিন্তু এ রকম একজন মানুষকে সে রকম প্রশ্ন করার কোনো মানে হয় না। জগতের অনেক কিছুই প্রশ্ন-উত্তরের ধার ধারে না।
ঘটনাটি কয়েকমাস আগের। জাহিদ হোসেন এখনও ভিক্ষা করেন কি না, জানি না, কিন্তু তাঁর যে ছবিটি তুলেছিলাম, সেটি মাঝে মাঝেই আমার স্মৃতিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে।
মনিরুল আলম

No comments

Powered by Blogger.