বৈসাবি-পাহাড়ের উৎসবের রং অমলিন থাকুক by ইলিরা দেওয়ান

চৈত্রের তপ্ত দুপুর। বাইরে কাঠফাটা রোদ। কিন্তু তবু পাহাড়ের ঘরে ঘরে এতটুকু আনন্দের কমতি থাকে না। চৈত্র মাস এলেই বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসবে পাহাড় মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিবছরই ঘুরে ঘুরে আনন্দের এ কটি দিন পাহাড়ের কোলে ফিরে আসে।


কিন্তু এই আনন্দময় সময়গুলো কখনো পাহাড়ের কোলে হাসি ফোটায়, কখনো কখনো এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সংঘটিত হয়, তখন পাহাড়ের আনন্দ বিষাদে ভরে যায়।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দুই দিন আর পয়লা বৈশাখ নিয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসব। কয়েক বছর ধরে পাহাড়ের এ উৎসবকে সংক্ষেপে ‘বৈসাবি’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’, চাকমারা ‘বিঝু’, তঞ্চঙ্গ্যারা ‘বিষু’, খিয়াংরা ‘সাংলান’, ম্রোরা ‘সাংক্রান’, চাকরা ‘সাংগ্রাইং’ নামে এ উৎসবকে অভিহিত করে থাকে। তবে এই বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এ সময়ে পাহাড়ের ঘরে ঘরে উৎসবের রং জেগে ওঠে। নাম জানা-অজানা অনেক ফুলে ফুলে প্রতিটি ঘর ভরে যায়। পাহাড়ি মানুষ ফুল দিয়ে নানা মানস রঙে সাজিয়ে তোলে যার যার ঘর।
বৈসাবি উৎসবের মূল প্রতিপাদ্যই হলো পুরোনো বছরের সব গ্লানি, হিংসা-বিদ্বেষ, দুঃখকে পেছনে ফেলে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। এ উৎসবে ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো আবহ নেই। তবে সব শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন রচনা করে এ উৎসব।
যে উৎসব অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে পালিত হয়ে থাকে, সেই উৎসবের মুহূর্তে বিগত কয়েক বছরের দিকে ফিরে তাকালে আমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকেই প্রত্যক্ষ করি। বিগত সময়ে পাহাড়ে ‘বৈসাবি’ উদ্যাপনের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলির দিকে ফিরে তাকালে দেখি, ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল লোগাং গণহত্যা, ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ এপি ব্যাটালিয়নের গুলিতে খাগড়াছড়ির পানখাইয়াপাড়ায় ক্যাজাই মারমা নিহত হন, ১৯৯৭ সালের ১২ এপ্রিল পকেটমারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির মাইচছড়ি বাজারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ির মাইচছড়িতে দুটি পাহাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ অর্ধশতাধিক গ্রামবাসীকে আহত করা হয়েছিল এবং চারজন পাহাড়ি নারী সেটেলারদের দ্বারা ধর্ষিত হন, ২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল বৈসাবির আমেজ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই রাঙামাটির সাজেকে পাহাড়িদের চারটি গ্রামের ৭৭টি বসতবাড়ি, একটি গির্জা ও দুটি ইউনিসেফ পরিচালিত পাড়া কেন্দ্র (প্রাক স্কুল) জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ২০১০ সালের ১৯-২০ ফেব্রুয়ারি সাজেকে আবারও হামলা হয়। এবার ১১টি গ্রামের পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি, দুটি বৌদ্ধ মন্দির ও একটি গির্জা জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির রামগড়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা। বৈসাবির নিকটবর্তী ধারাবাহিক এ ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে স্বাভাবিকভাবে সবার মনে আশঙ্কা দেখা দেয়, এবারের ‘বৈসাবি’ উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারব তো!
একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন বা আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে তখন মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই হুমকি প্রদান করে থাকে। কত ক্ষেত্রে সরাসরি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। যেমন ১৯৯৯ সালের উদীচীর ঘটনা, ২০০১ সালের পয়লা বৈশাখ রমনা বটমূলের নৃশংস ঘটনার কথা উল্লেখযোগ্য। যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতিশীলতার আবহ থাকে সেখানেই মৌলবাদীদের ঘোরতর আপত্তি। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, সমতলের এসব ঘটনার সঙ্গে পাহাড়ের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর কোনো যোগসূত্র নেই তো! আমরা বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ এখন জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কার ছত্রছায়ায় ঘাঁটি গেড়েছে সেটিও উদ্ঘাটন করা জরুরি। সমতলে যাদের পরিচয় জঙ্গি-যুদ্ধাপরাধী, পাহাড়ে গেলে কেন তাদের পরিচয় কেবল ‘বাঙালি’ হিসেবে বিবেচিত হবে? ২০০৬ সালে সংঘটিত পকেটমারের ঘটনায় আমরা দেখেছি, অপরাধী আর ‘অপরাধী’ থাকেনি। সে সময় তার বড় পরিচয় ছিল ‘সে বাঙালি’। কাজেই এসব সাম্প্রদায়িক মানসিকতা যত দিন দূর না হবে তত দিন পাহাড়ে জঙ্গি তৎপরতা নির্মূল বা জঙ্গি ঘাঁটি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে না। অনুরূপভাবে ‘বৈসাবি’ অনুষ্ঠানের মতো অসাম্প্রদায়িক উৎসবও নিরাপদ থাকবে না।
আমরা আশা করি, ‘বৈসাবি’ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে সব শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধ রচনা করে তা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। একই সঙ্গে যে শান্তি ও সমৃদ্ধিকে সামনে রেখে ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে ১৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হোক। চুক্তি সম্পাদনের পরও পার্বত্য চট্টগ্রামকে যে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে সেই চাদর সরিয়ে নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে মুক্ত বাতাস ছড়িয়ে পড়ুক।
শুভ হোক বৈসাবি।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকার কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.