টাকার বস্তা যাচ্ছিল সুরঞ্জিতের বাসায়! by পার্থ সারথি দাস

রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার গত সোমবার রাতে টাকার বস্তা নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রেলের মহাব্যবস্থাপককে সঙ্গে করে প্রাইভেট কারে চড়ে জিগাতলায় সুরঞ্জিতের বাসার দিকেই যাচ্ছিলেন। গতকাল বুধবার এপিএস ফারুক কালের কণ্ঠে ফ্যাক্সযোগে পাঠানো তাঁর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য


উল্লেখ করেছেন। রেল ভবনের একটি সূত্রও বিষয়টি স্বীকার করেছে। এদিকে গতকালই রেলমন্ত্রীর এপিএসের পদ থেকে ওমর ফারুককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
জানা গেছে, বেশির ভাগ সময়েই কাজ শেষে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে বের হতেন ফারুক। কিন্তু ওই দিন অনেক আগেই জাতীয় সংসদ ভবন থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। তবে রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেন, এপিএস ফারুক সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর গতকাল থেকে মন্ত্রীকে ফাঁসানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কথা বলছেন। আসলে সোমবার বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ফারুক মোহাম্মদপুরে তাঁর নিজের বাসার দিকেই যাচ্ছিলেন।
গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, মানুষ জান বাঁচানোর জন্য অনেক সময় অনেক কথাই বলে। সোমবার রাতে টাকাসহ গাড়িটি তাঁর বাসার দিকেই যাচ্ছিল- এ অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।
তবে রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঘটনার রাতে গাড়িচালক আজমকে মন্ত্রীর জিগাতলার বাসায় গাড়ি নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ কথা আমি রেল ভবনে অনেকের মধ্যেই আলোচনা হতে শুনেছি।'
রেলমন্ত্রীর কাছের লোক বলে পরিচিত ওমর ফারুকের দাবি, সোমবার রাত পৌনে ৯টায় তিনি সংসদ ভবন কার্যালয় থেকে বের হন। এরপর ল্যাবএইড হাসপাতালে গিয়ে স্ত্রীকে ডাক্তার দেখান। সেখান থেকে গাড়িযোগে মোহাম্মদপুরে নিজের বাসার দিকে যাওয়ার পথে তাজমহল রোডে স্ত্রী ও সন্তানকে নামিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় যান। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। সেখান থেকে জিগাতলায় মন্ত্রীর বাসার দিকে রওনা হন তাঁরা। কিন্তু পথিমধ্যে চালক মো. আজম খান হঠাৎ গাড়িটি বিজিবি সদর দপ্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে তাঁদের নেমে যেতে বলেন।
পালানোর ফন্দি আঁটছেন ফারুক : গত সোমবার রাতে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ বিজিবি সদস্যদের হাতে আটক নাটকের পর মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার রেল ভবনে নিজ দপ্তরে অফিস করেননি রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার। গতকাল রেল ভবনে এপিএসের দপ্তরে দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেকেই তাঁর দেখা পাননি। দুপুরে রেল ভবনে গেলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেই ফারুকের কাছে তদবিরের জন্য এসেছিলেন। এ অবস্থায় গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁর এপিএস ফারুককে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত জানান। জানা গেছে, সেটা টের পেয়েই ফারুক এখন পালানোর পাঁয়তারা করছেন। গতকাল বিকেলে তাঁরই ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে জানান, ফারুক যেকোনো সময় পালিয়ে যেতে পারেন। কারণ তাঁর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ বছর মেয়াদি মাল্টিপল ভিসা রয়েছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফারুক ওই ভিসা পেয়েছিলেন।
পিএস-এপিএস গোপন বৈঠক : গত মঙ্গলবার রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদ ভবনে নিজ দপ্তরে নিজের নির্বাচনী এলাকার লোকজন ও সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই সময় এপিএস ফারুকের ঘটনায় তাঁকে অনেকেই বিব্রত থাকতে দেখেন। মন্ত্রীর সঙ্গে ওই সময় আলোচনায় অংশ নেওয়া একাধিক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকেই রেলমন্ত্রীকে এপিএস পদ থেকে ফারুককে সরানোর পরামর্শ দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুরঞ্জিতের অনুসারীদের অনেকেই বহু আগে থেকেই এপিএস ফারুকের বিভিন্ন অপকর্ম সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু সুরঞ্জিত তা কানেই তোলেননি। মঙ্গলবার রাতে তদন্ত কমিটির দায়িত্ব পাওয়া রেলমন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামান সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থান করছিলেন। ওই রাতে তাঁর সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় দেখা করেন ওমর ফারুক। সূত্র জানিয়েছে, নিজের একাধিক গাড়িতে করে দলবল নিয়ে ফারুক পিএসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মানসিকভাবে তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থার কথা জানিয়ে পিএসের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন, যাতে তদন্তের প্রতিবেদন তাঁর পক্ষে যায়। মঙ্গলবার রেল ভবনে দুপুরে উপস্থিত হলেও পরে সেখান থেকে চলে যান ফারুক। কিন্তু পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
তদন্ত কমিটি শুরুতেই অকার্যকর : রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার টাকাসহ আটকের ঘটনা তদন্তে গঠিত দুটি কমিটি গতকালও কাজ শুরু করেনি। এপিএস ফারুকের বিষয়ে তদন্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর পিএস মো. আখতার-উজ-জামান গতকাল জাতীয় সংসদেই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত ছিলেন। বিকেল প্রায় ৫টার দিকে তিনি রেল ভবনে নিজ দপ্তরে আসেন। বিকেলে তাঁর কাছে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'আমি একটু আগে চিঠি পেয়েছি। এপিএস ফারুকের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ ১৫ দিনের মধ্যে তদন্তের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমি আগামীকাল (আজ) বৃহস্পতিবার তদন্তকাজ শুরু করব।'
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রেল মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শশী কুমার সিংহকে। গতকাল দুপুরে তাঁর দপ্তরে গেলে জানা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভায় যোগ দিতে সেখানে অবস্থান করছেন। তাঁর দপ্তর সূত্র জানায়, তদন্তের কাজ তিনি শুরু করেননি। এ বিষয়ে জানতে গতকাল বিকেলে বারবার মুঠোফোনে শশী কুমার সিংহের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
'আমি ধরা পড়িনি' : ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গত সোমবার গাড়িসহ বিজিবি সদস্যদের হাতে ধরা পড়লেও রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে বলেন, 'আমি ধরা পড়িনি।' বিকেলে নিজের স্বাক্ষর করা একটি প্রতিবাদপত্র তিনি কালের কণ্ঠে পাঠান। কিন্তু এর আগেই তাঁকে তাঁর পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী। গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে যোগাযোগ করা হলে রেলমন্ত্রীর পিএস আখতার-উজ-জামান বলেন, '১১ এপ্রিল থেকে ওমর ফারুক তালুকদারের সাময়িক বরখাস্ত কার্যকর হবে। আমি এখন এই নির্দেশনা জারি করব।'
এপিএসের প্রতিবাদ : গতকাল কালের কণ্ঠে পাঠানো প্রতিবাদপত্রে এপিএস ফারুক আটক হননি দাবি করে সোমবার রাতের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, জিগাতলাস্থ মন্ত্রী মহোদয়ের বাসার উদ্দেশে রওনা হই। আমার গাড়ির ড্রাইভার আজম খান কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটি রাইফেল স্কয়ারের পাশ দিয়ে পিলখানার ভেতর ঢুকিয়ে আমাদেরকে টাকার ব্যাগ রেখে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বলে। সে আমার মোবাইলগুলো ছিনিয়ে নেয়। সে গাড়ি থেকে নেমে বিজিবি সদস্যদের বলে, গাড়িতে অবৈধ টাকা রয়েছে। আমরা বিজিবিতে কর্মরত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিষয়টি জানাই এবং আমাদের অর্থ ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদানের অনুরোধ জানাই। তারা বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে। অন্যদিকে ড্রাইভার আজম নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে সাংবাদিকদের ডেকে এনে অন্য নাটক সাজায়, যা একবারেই মিথ্যা ও সুপরিকল্পিত। তিনি আবারও দাবি করেন, গাড়িতে ২৫ লাখ টাকা ছিল। তিনি কালের কণ্ঠে গতকাল প্রকাশিত 'রেলে নিয়োগ বাণিজ্যের হোতা এপিএস ফারুক' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, নিয়োগের সঙ্গে রেলের জিএমরা জড়িত থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.