সু চির সাত রঙ by শেখ রোকন

মিডিয়ার কল্যাণে তার ফুলেল খোঁপার খবর কে না জানে! বাংলার গ্রামে ও গঞ্জে অবহেলায় ঝরে যাওয়া জারুলও মিয়ানমারে গিয়ে কীভাবে জাতে উঠতে পারে, তার নমুনা সু চিই দেখিয়ে চলছেন। আমাদের নেত্রীদের কথা আলাদা। প্রকৃতি থেকে সৌন্দর্যের সূত্র আবিষ্কারে তাদের না আছে সময়, না সদিচ্ছা।


এ দেশীয় সুন্দরীদের যারা খোঁপায় ফুল গুঁজতে পছন্দ করেন, তাদের রুচিও বেলি-বকুলের নিচে নামে না। সু চির কাছে ফুলের অন্য কোনো পরিচয় নেই_ জংলায় না শখের বাগানে জন্মে, দেশি না বিদেশি, কম দামি না বেশি দামি, সে চিন্তার বালাই নেই তার। ফুল পেলেই হলো_ হোক তা সে জারুল বা সোনালু, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচূড়া। আমাদের বিল ভরে থাকা শাপলাকেও তার মাথায় আলো ছড়াতে দেখা গেছে। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন, সু চির খোঁপা হলো বার্মার ঋতুবদলের দিনপঞ্জি।
দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বের পর এবার যখন সু চি মুক্ত পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন; দেশি-বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেছেন; গত রোববারের নির্বাচনের দু'মাস আগে থেকে মিয়ানমারের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্ত ছুটেছেন; খোঁপার ফুলের পাশাপাশি নজর কেড়েছে তার পোশাকও। জনসাধারণ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কালে তিনি কেবল যোগব্যায়াম করে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেই যে সময় কাটাননি, তা স্পষ্ট। তার পোশাক মিয়ানমারের বস্ত্রশিল্প, ঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। সাধারণ বার্মিজদের সেই লুঙ্গি ও ব্লাউজই। কিন্তু রঙ ও নকশায় এক আশ্চর্য নতুনত্ব।
যেখানেই গেছেন কেবল পোশাকেই যেন অন্যদের উপচে গেছেন। থাই প্রধানমন্ত্রী ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় তার লাল-গোলাপি কিংবা গহিন সবুজ পোশাকের কাছে আর সব ম্লান হয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফ্যাশনসচেতনতার কথা জগৎ বিদারী। কাকতালীয়ভাবে রেঙ্গুনের বহুল আলোচিত একান্ত সাক্ষাতের দিন তারা দু'জনেই ওপরে সাদা, নিচের দিকে কালো পোশাক পরেছিলেন। কিন্তু সু চির গজদন্ত সাদা ব্লাউজের কাছে হিলারির সাদা টিউনিক কীভাবে ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল, তা কেবল প্রত্যক্ষদর্শীরাই জানেন। পরদিনের ফটোসেশনে হিলারি আর ঝুঁকি নেননি। তার বহুল পরিহিত আকাশি কোট আর কালো সুট পরে এসেছিলেন। আর সু চি পরেছিলেন ডিপ সায়ান ব্লাউজ আর চেক লুঙ্গি। খোঁপায় গোঁজা নাম না জানা গোলাপি ফুল। এএফপির তোলা সেদিনের আলোকচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে, সায়ানের গাম্ভীর্যের কাছে আকাশি কেমন ছেলেমানুষ।
মনে হচ্ছে, আদি অকৃত্রিম সু চি বিরতির পর জনতার মাঝে বের হয়ে এসেছেন পুরনো পোশাকের এক নতুন মাত্রা নিয়ে। মিয়ানমারের মানুষ তা লুফেও নিয়েছে। গৃহবন্দিত্ব অবসানের দিন সু চি স্বল্প সময়ের জন্য পৈতৃক বাড়িটির প্রধান ফটকে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরনে আলুবোখারা রঙের ব্লাউজ। সঙ্গে গোলাপি লুঙ্গির সেই ম্যাচিং পোশাক দ্রুতই তার ভক্তদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারণায় যে এলাকাতেই গেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে সু চির রঙ ও ডিজাইনের ব্লাউজ বানানোর ধুম পড়ে গেছে। তার সফরের সপ্তাহের মাথায় যেন ওই অঞ্চল ভরে গেছে হাজারো সু চিতে।
ইরাবতি ম্যাগাজিনের কাছে রেঙ্গুনের এক দর্জি বলছেন, গত কিছু দিন ধরে তার কাছে মেয়েরা আসছে সু চির পেপার কাটিং ছবি নিয়ে। বলছে, এই ডিজাইন, এমন গলার ব্লাউজ বানিয়ে দিতে হবে। তাদের বেশিরভাগই টিনএজার। অগত্যা দর্জিরা এখন সু চির অ্যালবাম রাখা শুরু করেছেন। ৬৬ বছরের সু চি টিনএজারদের এতটাই প্রভাবিত করেছেন, স্কুল-কলেজ পড়ূয়া যে মেয়েটি দুই মাস আগেও জিন্স পরেছে, এখন সে সু চির মতো লুঙ্গি ও ব্লাউজ ধরেছে। রেঙ্গুনের এক শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ডিজাইনার ম্যাগাজিনটিকে বলেছেন, সু চি এখন ফ্যাশন দেবী। তার পোশাকে ব্যবহৃত খাঁটি দেশি কাপড়গুলো যেমন সহজলভ্য, তেমনি দামেও সস্তা। বার্মিজ নাগরিকদের জন্য যেমন মনের মতো, তেমনি নাগালের মধ্যে। একেবারে সু চির মতোই।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.