গণতন্ত্র-মিয়ানমারের সোনার হরিণ by জয়তী ঘোষ

ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় আর রাজধানী নেপিডোর হোটেলগুলো উপচে পড়ছে। বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা শশব্যস্ত হয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবার করে যাচ্ছেন। মিয়ানমারের খনিজ আর বাজার ভাগাভাগির হিড়িক লেগেছে। বহুজাতিক কোম্পানি আর সাহায্য সংস্থাগুলোও হাজির। তাদের ল্যাপটপ ভরা বহু রকমের নীতি-পরামর্শ আর প্রস্তাব।


দৃশ্যটা কল্পনা করুন: প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক দেশ, অর্ধশতাব্দী ধরে দেশটি শাসন করছে সামরিক জেনারেলরা। সামরিক জান্তা প্রাণপণে এত দিন বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছে আর দেশের ভেতরে চালিয়ে কঠিন দমন-পীড়ন। এখন তারাই দেশের ভেতরে কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, আর চাইছে বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়াতে। যারা মুনাফালোভী, যারা ভিনদেশি পরোপকারী, তাদের সবার জন্যই এটা এক বিরাট সুযোগ।
বাইরের দুনিয়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে একটা মোটা দাগের মানদণ্ডেই বুঝে থাকে। তা হলো সেনাবাহিনী বনাম ব্যাপক বন্দিত অং সান সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। কিন্তু আসল পরিস্থিতি আরও জটিল। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে চলছে ক্রমশ বদলে যাওয়া শত্রুর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ। কেবল আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনই নয়, বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট অভ্যুত্থানমুখী তৎপরতাও হয়েছে। এসবের দ্বারা শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নমূলক তৎপরতাকে চিহ্নিত করা হয়। তারাও এসব মোকাবিলা করতে করতে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের সামরিকায়ন ঘটিয়ে চলেছে।
অতীতে মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা যদি ‘বার্মার বিশেষ রকম সমাজতন্ত্রের’ গর্ব করেও থাকে, ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিক থেকে তা বাতিল হতে থাকে। এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে। তখন সেনা-সমর্থিত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণকে আড়াল করতে সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করা হয়। আসলে যা হয় তা হলো, এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রগুলোতে (বাণিজ্যিক ফসল, তেল, খনিজ ও মূল্যবান ধাতু এবং সম্প্রতি আবিষ্কৃত সমুদ্রের মজুদ গ্যাস) বিদেশি বিনিয়োগ আনা হয়। এসব বিনিয়োগের বেশির ভাগই আসে সেসব দেশ থেকে, যাদের পশ্চিমা ধরনের অবরোধ আরোপ করেনি, যেমন—চীন। এসবের ফলে যে আর্থিক বিকাশ ঘটে, তাকে দুনিয়ার অনেক দেশের অভিজ্ঞতায় বলা হয় ‘সম্পদের অভিশাপ’। মানুষের জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য আসেনি, উন্নত হয়নি জীবনমান। বেশির ভাগ মানুষই মূলত অতিগরিব। মৌলিক অবকাঠামোও যা নির্মিত হয়েছে, তা মূলত সম্পদের বৈষম্যপূর্ণ বণ্টনের নজির হয়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগের কোনো সুফল মিয়ানমারের জনগণ পায়নি।
এরই মধ্যে ২০১০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সবাই ভেবেছিল এটা আসলে লোক দেখানো নির্বাচন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এটাই খেলার নিয়ম বদলে দিল। অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন নিশ্চয়ই জেনারেলদের নীরব সমর্থন পাচ্ছেন এবং তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আকাঙ্ক্ষার থেকেও দ্রুতগতিতে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন।
বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে গণতন্ত্রপন্থী নেতারাও আছেন। পশ্চিমে এসব কর্মকাণ্ডের থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পয়লা এপ্রিলের নির্বাচন, যেখানে মাত্র ৪৫ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন মোটামুটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষই হয়েছে এবং অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বিপুল বিজয় পেয়েছে।
অর্থনৈতিক পরিবর্তনের গতি চমক লাগিয়ে দিয়েছে, এমনকি অনেকে হতভম্বও হচ্ছেন। মিয়ানমারই একমাত্র দেশ, যার বেলায় এমনকি আইএমএফও বলছে যে এত দ্রুতগতিতে অর্থনীতিকে খুলে দিলে সমস্যা হতে পারে। মিয়ানমারে সবাই এখন সোনার হরিণ ধরতে মরিয়া।
পাকিস্তনের ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জয়তী ঘোষ: ভারতীয় অর্থনীতিবিদ।

No comments

Powered by Blogger.