বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৬৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হারিছ মিয়া, বীর প্রতীক অসীম সাহসী এক যোদ্ধা বীরযোদ্ধা হারিছ মিয়া ২০০৮ সালের মে মাসে মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন দিনাজপুর এলাকায়।


পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ, সিলেটের গোয়াইনঘাট, রাধানগর, ছাতকসহ আরও কয়েকটি স্থানে যুদ্ধ করেন। তিনি ছিলেন নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর।
মুক্তিযুদ্ধকালে এই রেজিমেন্টের ডেলটা (ডি) কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম (১৯৭১ সালে লেফটেন্যান্ট)। তিনি বাহাদুরাবাদ, রাধানগর, গোয়াইনঘাট ও ছাতক যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁর বইয়ে হারিছ মিয়ার নাম আছে। রাধানগরের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দিন ধরে যুদ্ধ হয়। রাধানগরের ছোটখেল আক্রমণের বিবরণে তিনি লিখেছেন:
‘২৮ নভেম্বর ১৯৭১। ভোর চারটা বাজতে আরও পাঁচ মিনিট বাকি। আমরা সবাই এক সারিতে হেঁটে হেঁটে অ্যাসল্ট লাইনে পৌঁছে গেলাম। চারদিক তখনো ঘন কুয়াশায় ঢাকা। ২০-৩০ ফুট দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সব সহযোদ্ধাকে এক্সটেনডেড ফরমেশনে দাঁড় করালাম।
‘সবাই দ্রুতবেগে সামনে এগোতে লাগল। প্রতিটি সৈনিকের অস্ত্রগুলো থেকে শত শত গুলি সামনের দিকে ছুটতে লাগল। একই সময় ঘোরা ও দুয়ারিখেল গ্রামের উত্তর প্রান্তের অবস্থান থেকে আমাদের দুটি মেশিনগান ও দুটি আরআর গুলি ছুড়তে লাগল শত্রুর ছোটখেল অবস্থানের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের দিকে তাক করে। সব মিলিয়ে এক প্রলয়ংকরী অবস্থার সৃষ্টি হলো।
‘ভোরের আলো তখন ফুটে উঠেছে মাত্র। আমাদের অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানিরা বাংকার ছেড়ে যে যেখানে এবং যেদিকে সম্ভব দৌড়ে পালাতে থাকল। খড়স্তূপের আগুনে চারদিক তখন আলোকিত হয়ে উঠছে।
‘আমাদের যোদ্ধারা অপ্রত্যাশিত বিজয়ে আনন্দে আত্মহারা। তারা বাংকার টু বাংকার ফাইট করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল। কোনো কোনো অবস্থানে বেয়নেট চার্জ করে শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো। চারদিকে তখন যেন রক্তের বন্যা। পাকিস্তানিরা তাদের পরনের উর্দি পর্যন্ত ফেলে পালাল। উর্দি পরার সুযোগও পেল না। আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সৈনিক এ সময় এক অশরীরী শক্তির অধিকারী হয়ে এক একটি ব্যাঘ্রের রূপ ধারণ করে পাকিস্তানিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
হারিছ মিয়া রাধানগর এবং অন্যান্য যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাঁর কোম্পানির অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও উপ-অধিনায়ক দুজনই ছিল অবাঙালি। মার্চ মাসে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে তাঁদের চারটি কোম্পানিই সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয়। সেনানিবাসে ছিল হেডকোয়ার্টার কোম্পানি এবং রিয়ার পার্টি। ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর হারিছ মিয়া ছিলেন সেনানিবাসে। ৩০ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের আক্রমণ করে। সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি সেনারা তাঁর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হারিছ মিয়াকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৪৪।
হারিছ মিয়ার পৈতৃক বাড়ি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আহম্মদ হোসেন। মা মফিজননেছা। স্ত্রী খাদিজা বেগম। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক এবং অপারেশন রাধানগর, লে. কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম। ছবি: মঈনুল ইসলাম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.