শিক্ষা-উচ্চশিক্ষার মান নিচে নামছে কেন? by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার সর্বস্তরেই যে মানের অবনতি ঘটছে, সে বিষয়টি পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে প্রচারিত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ইন্টার উইং বৃত্তি পেয়ে আমাদের দেশ থেকে অনেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পড়তে যেত।


অধিকাংশ সময়ই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী পেত। কলেজের ছাত্র থাকাকালীন আমি বিষয়টি নিয়ে গর্ব বোধ করতাম যে পাকিস্তান আমলে নানা বঞ্চনার শিকার হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার মানে আমরা অগ্রগামী ছিলাম।
এ মাসেই আমাদের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি হবে। সেনাশাসনের কবলে পাকিস্তান আমাদের থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার পরও শিক্ষার মানের পরিসংখ্যানে দেশটি আমাদের থেকে বেশ একটু এগিয়েই, যদিও আমাদের প্রতিটি সরকার শিক্ষায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভিশনের মধ্যে রয়েছে আমাদের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন; পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে অবদান রাখা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎকর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করা; জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বিশ্ব পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণার যোগসূত্র তৈরি করা।
এই কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে উল্লেখ করার মতো সাফল্য অর্জন করেছে, তা বলা যাবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে মনে হয়, আমরা উচ্চশিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিবছর র্যাংক দেওয়া হয়—তাদের মধ্যে উৎকর্ষ অর্জনে একটি প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হাফহার্টেড র্যাংকিং দিয়ে পরে পিছিয়ে পড়ল।
সুখের বিষয় এই, মঞ্জুরি কমিশন আবার উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহাসমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাতে যথাযথভাবে প্রকল্প প্রণয়ন ও দাখিল করতে পারেন, এ জন্য একাধিক রঙের নির্দেশিকা তৈরি করেছে এবং সম্ভবত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে বিশ্বের ২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের দেশ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় টাইমস হায়ার এডুকেশন কিংবা সাংহাই জিয়াওটং বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম লেখাতে পারেনি। ওয়েবমেট্রিক্স র্যাংকিংয়ের অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ তালিকায় দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আমরা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার পেছনে পড়েছি; সংখ্যার বিচারে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, পাকিস্তান ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং আমাদের অবস্থান সহজেই অনুমেয়। ওয়েবমেট্রিক্স র্যাংকিংয়ে অবস্থান উন্নয়ন খুব কঠিন নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জনের তালিকা দিয়ে হোমপেজ সমৃদ্ধ করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোমপেজে আমাদের শিক্ষক-গবেষকদের নাম, ছবি, যোগাযোগের ঠিকানা, কখনো কখনো গবেষণার ক্ষেত্রগুলোর তালিকা থাকে; খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁদের গবেষণা-সাফল্যের বৃত্তান্তে হোমপেজ সমৃদ্ধ হয়। আজকাল হোমপেজ হলো যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দর্পণ, যার মাধ্যমে গোটা সমাজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কিংবা প্রতিষ্ঠানকে দেখতে পারে, তার সাফল্য নিয়ে গর্ব বোধ করতে পারে। এ জন্য শুধু উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের প্রত্যেক শিক্ষক তাঁর অর্জনের বৃত্তান্তে হোমপেজকে সমৃদ্ধ করেন। অনেক সময় একজন তরুণ গবেষক কিংবা ছাত্র লব্ধপ্রতিষ্ঠ শিক্ষক ও গবেষকদের অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এমনটি নেই।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেছিলেন এক আমেরিকান নোবেল বিজয়ী। তাঁকেও কিন্তু তাঁর জীবনবৃত্তান্ত হোমপেজে রাখতে হয়েছিল। আমরা স্বচ্ছতার কথা বলছি, কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্বচ্ছতা কই? উচ্চশিক্ষার শিখরসম প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কোনো ব্যক্তিত্বেরই জীবনবৃত্তান্ত সেখানে নেই। সাধারণ শিক্ষকেরা কীভাবে উৎসাহিত বোধ করবেন! আমি নিশ্চিত, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-গবেষকেরা যদি তাঁদের গবেষণা বা শিক্ষা-সাফল্য দিয়ে হোমপেজ সমৃদ্ধ করতেন, তাহলে অন্তত ওয়েবমেট্রিক্স র্যাংকিংয়ে ১০ গুণ ক্ষুদ্র শ্রীলঙ্কার পেছনে পড়তে হতো না আমাদের।
গত কয়েক দিনের প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা, যদি আমরা উচ্চশিক্ষার মান উন্নত করতে চাই। HEQEP প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের যে কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তা-ও একটি সঠিক পদক্ষেপ। তবে প্রকল্প গ্রহণকারীদের সম্পর্কে যে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে, তা দেখে আমি অবাক হলাম (অ্যাটাচমেন্টে নির্দেশিকার পৃষ্ঠা নম্বর ৭৭)। একজন গবেষকের স্নাতক, স্নাতকোত্তর শিক্ষার সাল ও যেসব পদ তিনি অলংকৃত করেছেন, এই বৃত্তান্ত এবং তাঁর প্রকল্প সম্পর্কে লেখা পড়ে আমরা কোটি কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে দিচ্ছি। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর অনেক প্রকল্প নামকরা গবেষকেরা লিখেছেন, তা কেউ তুলে দিলে সেই প্রকল্পকে খারাপ বলার সুযোগ নেই। তবে সেই প্রকল্পটি আমাদের গবেষক করতে পারবেন কি না, তা আমরা কী করে বুঝব?
ভাবলাম, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিশ্চয়ই হোমপেজ খুঁজে প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করে নিয়েছে। সফল ৯১টি প্রকল্পের যে তালিকা দেওয়া আছে, তার প্রতিটি খোঁজার চেষ্টা করলাম। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিংকে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। কেবল চার-পাঁচটি প্রকল্পের গবেষকদের কিছুটা বৃত্তান্ত পাওয়া গেল। অন্য কারও গবেষণা-সাফল্যের তালিকা পাওয়া গেল না; কখনো শুধু নাম, ছবি কিংবা ঠিকানা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। তাহলে একজন গবেষকের গবেষণার সাফল্য কিংবা শিক্ষকের স্বীকৃত সাফল্য না জেনেই আমরা কোটি টাকার অনুমোদন দিয়ে জনগণের টাকার সদ্ব্যবহারে কীভাবে নিশ্চিত হলাম? একজন নবীন গবেষককে তিন-চার কোটি টাকা দিয়ে আমরা প্রকৃতপক্ষেই যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি পড়ালেখাকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প। তা ছাড়া অনেক প্রকল্পের নাম দেখে মনে হলো, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্ক সামান্যই।
অবশ্য নির্দেশিকা থেকে পরিষ্কার এই প্রকল্পগুলো খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করেই বাছাই করা হয়েছে। কম্পিউটার বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। এই প্রকল্পগুলো কে বাছাই করেছে, সে সম্পর্কে শুধু আমার নয়, আমার আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো শিক্ষকেরও জানা নেই বলে মনে হলো। আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী আশা করছেন, তাঁরা রিভিউ রিপোর্ট পাবেন। সহায়িকায় অবশ্য আপিল করার সুযোগের কথা বলা আছে। কেউ আপিল না করেও তো তাঁর প্রকল্পের দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে চাইতে পারেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তা জানানো হলেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। আবেদনের ফরমটি দেখে মনে হয়েছে, আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে ঘাটতি রয়েছে, জনগণের অর্থ ব্যয় করার যে গুরুদায়িত্ব অর্পিত আছে, তার ভার নেওয়ার জন্য আমরা এখনো প্রস্তুত নই।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় যে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার জন্য টাকা বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে, তার সাফল্য নিয়েও রয়েছে শত প্রশ্ন।
এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার সময় আমরা কি ভেবেছি, আমাদের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন কীভাবে নিশ্চিত হবে? এই প্রকল্পের শেষে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকের উন্নতি ঘটবে, আমরা কি পাকিস্তানের শিক্ষার মানের কাছাকাছি আসতে পারব? আমি যথেষ্ট সময় দিয়ে সফল গবেষকদের জীবনবৃত্তান্ত ইন্টারনেটে ঘেঁটেছি। তা ছাড়া আমার নিজের বিষয়ে তো মোটামুটি সবাইকে চিনি। আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।
বিগত কয়েক বছরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিক র্যাংকে পিছিয়েছে। HEQEP প্রকল্প বাস্তবায়নে এই পিছিয়ে পড়াকে থামাতে পারবে বলে মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষক-গবেষকদের জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে হোমপেজ সমৃদ্ধ করতে পারে, তাহলে হয়তো বা আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.