চারদিক-কেমনে দেব ভব পাড়ি... by সাহাদাত পারভেজ

হাওরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে সুরমা নদী। নদীর দুই পাশের দিগন্তবিস্তৃত মাঠে রোপিত ধানের চারা, প্রাণের বীজ। সবুজ বীজতলায় স্বপ্ন বড় হয় নিঃশব্দে, একাকী। নদীপৃষ্ঠে আঁকাবাঁকা রেখা এক প্রতিজীবনের গল্প আঁকে, ডাকে শুকিয়ে যাওয়া জলরেখা—‘জীবন বহিয়া যায়...’।


এই হচ্ছে ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ—বাউলসাধকের দেশ। শেষ বিকেলে সুরমা নদীর ধারে বাঁশঝাড়ের তলায় একটি গান বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ‘আমার সুখ পাখিটা গেছে উড়ে, একটা তিরের আঘাত পাইয়া গো, আমি আইজও কান্দি পাখিটার লাগিয়া’। এটা মাতাল রাজ্জাকের গান। গাইছেন গোলাপ মিয়া।
পঞ্চাশোর্ধ্ব গোলাপ মিয়া এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিল্পী। টাইফয়েড তাঁর চোখের আলো কেড়ে নিয়েছে। অথচ বুকে তাঁর অজস্র গান। চলাফেরায় সামর্থ্য নেই। তাই ১২ বছরের ছেলে এমরান হোসেন তাঁর সব সময়ের সঙ্গী, গানের সাথি। বাবা-ছেলে মিলে বসান গানের আসর। গানের সুরে সুরে তাঁরা বলে যান মানুষের প্রাত্যহিক জীবনগাথা। ‘আমার প্রাণ তারে দেখতে চায়, আমার মন তারে দেখতে চায়, আমি যাব মদিনায়। হাতে নাই টাকাকড়ি, কেমনে দেব ভব পাড়ি, সাধের বেলা ডুইবা যায়’। এমন গানের মাঝখানে শ্রোতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে মুখর হয় গানের আসর।
গোলাপ মিয়ার জন্ম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের কাইয়ারগাঁও গ্রামে। বাবা দেওয়ান আলী ছিলেন একজন আলেম। বাবার গেরস্তি ছিল, সম্পত্তি ছিল। ১৫ বছর বয়সে নিজের চোখের আলো ও বাবাকে হারিয়ে ফেলায় সংসারে অভাব দেখা দেয়। কী করবেন, বুঝতে না পেরে একদিন গোলাপ মিয়া গেলেন গ্রামের স্কুলশিক্ষক আবদুর রশিদের কাছে। রশিদ মাস্টার বললেন, ‘তোমার তো ভালো গলা, কিছু গান লিখে দিই, তুমি গাইতে পারো।’ মাস্টারের লেখা ১২টি গান দিয়েই শুরু। এখন নিজের লেখা গান ছাড়াও শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, মাতাল রাজ্জাক, সালাম সরকার, শাহজাহান বয়াতি, দুরবিন শাহ ও কারি আমির উদ্দিনের গান গেয়ে থাকেন। সুনামগঞ্জের পুরোনো কোর্ট, সিলেটের হজরত শাহজালালের মাজার, জাফলং ও ভোলাগঞ্জ এলাকায় গান গেয়ে বেড়ান তিনি। দৈনিক আয় ১০০ থেকে ২৫০ টাকা। পরিবারে আছে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। এ উপার্জনেই চলে ছয়জনের সংসার।
চোখ নেই গোলাপ মিয়ার, মনের চোখেই এখন পৃথিবী দেখেন। গান তাঁকে সুস্থ রাখে। সংসারের হাজার সমস্যার মাঝে থেকেও গানের মূর্ছনা দিয়ে সবকিছু রঙিন করে নেন। হাওরের বাতাস লাগে শরীরে। শরীর জুড়িয়ে যায়। সেই সঙ্গে মনও কি জুড়ায় তাঁর?
গোলাপ মিয়া জানান, মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। যুদ্ধের একটি ঘটনা প্রায়ই ভাসে তাঁর দৃষ্টিহীন চোখে। তখন বয়স ছিল ১২, চোখে দেখতে পেতেন সবকিছু। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ২০ কেজি ওজনের গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে নদী পার করে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিশালতায় এটা হয়তো খুব বড় কোনো কাজ নয়। কিন্তু এ রকম ছোট ছোট শিশিরবিন্দু দিয়েই তো রচিত হয়েছে পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কতটাই বা আমরা জানতে পেরেছি? ১২ বছর বয়সী ছেলেটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বয়ে নিয়ে গেছেন গুলির বাক্স। সেই গুলিই হয়তো শত্রু তাড়ানোর কাজে লেগেছিল। এই কাজের জন্য তিনি গর্ব করতেই পারেন।
গানের সময় গোলাপ মিয়া বেহালা বাজান আর ছেলে বাজায় ডুগডুগি। মানুষজন মুগ্ধ হয়ে শোনে বাবা-ছেলের গান। বাবা শুরু করেন, ‘দুই দিনের লাগিয়া মানুষ কেন বা পাঠায়, মানুষ এই ভবে পাঠায়, খালি হাতে যায় রে মানুষ খালি হাতে যায়’। ছেলে এমরান হোসেন ধরে গানের পরের কলি, ‘ও মন, বিয়া অইলে বাসর অয় না, দেখেছি এমন ঘটনা, কোন দিন জানি কার বাতি নিব্বা যায়, ও মানুষ কেমনে মরে যায়’। রাঙা থালার মতো সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যায় পশ্চিম আকাশে। এবার গোলাপ মিয়া ধরেন গানের শেষ কলি, ‘লোভ-লালসে নত হইয়া করি কত দুষ, গোলাপ রে তোর হইল না হুঁশ, সময় বইয়া যায়, আমার গোনার দিন ফুরায়, মানুষ কত অসহায়, খালি হাতে যায় রে মানুষ, খালি হাতে যায়...।’

No comments

Powered by Blogger.