গন্তব্য ঢাকা-শহরে আসতে মন চায় না by শর্মিলা সিনড্রেলা

কত রকম মানুষ আসেন ঢাকায়! রাজধানী বলে ঢাকাকে খুব ভালো বেসে ফেলেছেন, সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন নয়। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট জমিয়ে রেখেও ঢাকায় থাকতে বাধ্য হয় কেউ কেউ। হয়তো অনেকেই। কিন্তু তারপরও থাকতে হয়। অন্য কোনো উপায় নেই আর।


একের পর এক কেটে যায় দিনগুলো, আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচের খাতাটাও লম্বা হতে থাকে প্রতিনিয়ত। মাসের ১ তারিখ শুরু হয়, সেই সঙ্গে শুরু হয় বাসা ভাড়া দেওয়ার চিন্তা। এভাবে যখন জীবনের পাতা থেকে মুছে যায় একটি বছর, তখন আরেক নতুন যন্ত্রণা। কোনো কথা ছাড়াই বাড়ানো হবে বাসাভাড়া। এভাবে আর কত দিন ভালো লাগে? দিনের পর দিন কিছু রক্তচোষার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে লিখনদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন। তাই বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় যে বাসাভাড়া দিয়ে থাকতে হয়, এ জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়। ঢাকায় এই চাপটাই অনেক বেশি। বাসাভাড়াও অনেক বেশি। একটা মাত্র ঘরেই আমি, আমার স্ত্রী, সন্তান, ছয় ভাই, এক বোন, বাবা-মা সবাই মিলে থাকি। ভাড়া দিতে হয় তিন হাজার টাকা। আর একটা ঘর নিলে কীভাবে চলবে? আয় তো হয় মাসে আট হাজার টাকার মতো।’
গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত অনেকেই এই ঢাকায় এসে বন্দী পাখির মতো ছটফট করেন। মো. লিখন তাঁদেরই একজন। গ্রামের বনবাদাড়ে টই টই করে ঘুরে বেড়ানো তাঁর অভ্যাস। এই শহর তাই মোটেও প্রভাব ফেলে না তাঁর মনে। কিন্তু গ্রামে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে দিন গোনা ছাড়া কী আর করার আছে তাঁর?
ঢাকায় যাদের বেড়ে ওঠা, তারা কখনোই গ্রামে ফেরার এই আর্তিটুকু বুঝবেন না। গ্রামের বিশাল মাঠে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দ কি ঢাকায় বসে পাওয়া যায়?
মাদারীপুরের কালিকাপুর গ্রামে সবাইকে নিয়ে বেশ সুখেই জীবন যাচ্ছিল মো. লিখনের। কিন্তু ছোট্ট লিখন তখন বুঝতে পারেননি সংসারের চাকাটা ঘোরাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁর বাবা সোবহান মৃধাকে। তাই একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। বাবার কথা বলতে গিয়ে লিখন বলেন, ‘বাবা ছিলেন খুব সোজা মানুষ। বাবার চাচাতো ভাইয়েরা বাবার সব জমি কেড়ে নিয়েছিল। বাবা সংসার চালাতে পারত না দেখে বাবাই চাইছিল ঢাকায় আসতে। সেই আমরা সবাই একসঙ্গে ঢাকায় চলে আসলাম।’
‘গ্রামের কথা খুব মনে হয়। যদি আমাদের একটু জমি থাকত তাহলে আর এক দিনের জন্যও এই ঢাকা শহরে থাকতাম না। আমরা আগে অনেক গাছে উঠতাম আর সাঁতার তো রোজই কাটতে হতো। তা না হলে যেন শান্তি পেতাম না। একদিন তো অনেক বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে গেছি নদীতে সাঁতার কাটতে, কিন্তু তখনো সাঁতার শিখিনি। আমার বন্ধু আমাকে ধাক্কা দিয়েছে আর আমি একেবারে নদীতে। আমার ফুপাতো ভাই খবির আমাকে হাত ধরে টেনে তুলেছিল বলেই বেঁচেছিলাম সেদিন। তা না হলে যে কী হতো?’ নিজের ছোটবেলার কথা মনে হতেই হাসির রেখা ফুটে ওঠে মো. লিখনের চোখেমুখে।
গ্রামে থাকেন লিখনের নানি। অনেক আদর করেন তাঁকে। এমনিতেই গ্রামে পড়ে থাকে মনটি। উপরন্তু গ্রামে গেলে নানি যে আদর করেন, তা ফেলে আর কোনোমতেই এই শহরে আসতে মন চায় না তাঁর। বলেন, ‘আমরা গ্রামে গেলে নানি অনেক রকমের পিঠা তৈরি করেন, আর মাংস-পোলাও তো আছেই। আমার নানাও আমাকে অনেক আদর করতেন। আমার বিয়ের জন্য বউও নানাই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু নানা আমাদের বিয়েটা দেখতে পারেননি। পাশের রাসতী গ্রামের মেয়ে মেরিনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নানা মারা যাওয়ার পর। আমি যখনই হোক গ্রামে চলে যাব। আমরা কেউ আর ঢাকায় থাকতে চাই না।’
টাকার অভাবেই ঢাকায় এসেছিলেন লিখনের বাবা। বস্তিতে থাকতেন আর রিকশা চালিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একদিন সেই বস্তিও ভেঙে দেওয়া হলো। বাধ্য হয়ে আবার ফিরে গেলেন গ্রামে। গ্রামেরই কিছু উদার মানুষ একটু জমি দিয়েছিলেন বাড়ি করে থাকার জন্য। মাথা গোঁজার ঠাঁই না হয় হলো। কিন্তু পেটপূজাও তো করতে হবে। তাই আবার চলে এলেন ঢাকায় জীবিকার সন্ধানে। ধীরে ধীরে লিখনরা বড় হয়ে উঠলেন। শুরু করলেন কাজ করা। এভাবেই চলছে আর এখন তো সবার একটাই স্বপ্ন, গ্রামে এক টুকরো জমি কিনে সেখানে ঘর বাঁধা। ব্যস, তাহলে আর এত কষ্ট করতে হবে না।
আর এই স্বপ্ন বাস্তব করতেই দিনরাত কাজ করে চলেন সবাই মিলে। আগে সোনারগাঁও মোড়ের সামনে একজনের সঙ্গে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করতেন মো. লিখন। তারপর একদিন নিজেই কিনলেন সেই মেশিন, তারপর কিছু টাকা জমিয়ে ভাবলেন আর একটু বড় কিছু করতে হবে। তাই পপকর্ন তৈরির মেশিন কিনে বসলেন। আর এখন রোজই সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এই মেশিন দিয়ে পপকর্ন তৈরি করেন তিনি বিজয় সরণির মোড়ে জিয়া উদ্যানের সঙ্গে লাগোয়া ফুটপাতে। কে জানে এই পরিশ্রমই হয়তো একদিন সফল করে দেবে লিখনদের সবার স্বপ্নকে।

No comments

Powered by Blogger.