সুর ও স্বর-শুদ্ধরূপে জাতীয় সংগীত গাইতে চাই by শীলা মোমেন

অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। এই সংগ্রামে প্রেরণা ও আবেগ সঞ্চার করে স্বাধীনতার ভাবাদর্শ নির্মাণে বড় ভূমিকা ছিল দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের। সেদিন সংগীত ছিল আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের এক বড় হাতিয়ার।


এই সংগীতের একটি খনি ছিল রবীন্দ্রনাথের সংগীতভান্ডার। ষাটের দশকে আন্দোলনের মঞ্চে আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে গাইতে গাইতে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত, আদৃত হয়েছে। এ গান আমাদের সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে যেমন গাঁথা হয়ে গেছে, তেমনি আমাদের অন্তরঙ্গ ভালোবাসায় জড়িয়ে আছে।
যে গানের এমন গৌরবময় ইতিহাস, যে গান এমন উচ্চ মর্যাদায় আদৃত সেটির শুদ্ধতা—বাণীতে, উচ্চারণে, সুরে ও গায়নে বজায় রাখার গুরুত্ব নিশ্চয় নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেখা যাচ্ছে গণমানুষের গান হতে গিয়ে, এবং পরে জাতীয় সংগীত হিসেবে সর্বত্র গীত হওয়ার মাধ্যমে, এ গানের সুরে তারতম্য ঘটে যাচ্ছে। হয়তো সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু যে প্রমিত রূপ আনুষ্ঠানিকভাবে গীত-প্রচারিত হয়, সেটিই কি এ গানের কবি-নির্দেশিত ও কবির অভীষ্ট প্রামাণ্য রূপ?
আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ খাঁটি বাংলা গান। কি কথায় কি সুরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে এর চেয়ে উপযুক্ত গান সত্যিই আর হয় না। গানটি স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় গেয়ে গেয়ে আপামর জনগণের মনে বিশেষ স্থান করে নিয়েছিল, এ কথা সত্য; তাই এ গানটিই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ছিল যেন স্বাভাবিক ও সংগত। এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল নিতান্তই আনুষ্ঠানিকতা।
এবারে মূল কথায় আসি। রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছেন বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের লোকসংগীতের সংগ্রহ হারামনি গ্রন্থের ভূমিকায় এ গানটির সুরের উৎসের সন্ধান দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন, ‘আমার মনে আছে তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিলেন—কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যেরে।...
কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।’
এ গানটির বাউল সুরের অনুসরণে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির সুর তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রসংগীতের ভান্ডারে এ ধরনের আরও কিছু গান আছে, যেগুলো অন্য গানের অনুপ্রেরণায় রচিত। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির সুরের কাঠামোটি মোটামুটি উল্লিখিত বাউলগানের মতোই, তবে হুবহু নয়। রবীন্দ্রনাথের সংগীতশৈলীতে বিন্যস্ত এ গানে তাঁর নিজস্ব সাংগীতিক ছাপ স্পষ্ট। একে বলব বাউলাঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত। গানটি ৪৬ সংখ্যক স্বরবিতানে মুদ্রিত হয়েছে। স্বরলিপি করেছেন কবির প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী।
শ্রীসুরেণ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্র-সঙ্গীত-কোষ গ্রন্থে এই গানটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট ১৯০৫ খৃস্টাব্দে কলকাতায় টাউন হলে যে সভা হয় সেই উপলক্ষে গানটি রচিত। ১৯০৫ খৃস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর সঞ্জীবনী পত্রিকায় এবং পরে বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রের আশ্বিন ১৩১২ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে সুরেন্দ্রবিজয় দে গানটি প্রথম রেকর্ড করেছিলেন, রেকর্ড নং-P-5784। পরবর্তী সময়ে কলম্বিয়া থেকে গোপালচন্দ্র সেন গানটি রেকর্ড করেন, রেকর্ড নং-N-706। স্বরলিপি প্রকাশিত হয় সঙ্গীত প্রকাশিকা, আশ্বিন ১৩১২ সংখ্যা অর্থাৎ ১৯০৫ খৃস্টাব্দে।’
এ দেশে এ গান ব্যাপকভাবে গাওয়া হয়েছে ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলনের সময় থেকে। শুদ্ধরূপে এ গান গাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার শুরু তখন থেকেই। তখন যে সুরে গানটির প্রচলন হয়, দেখা গেল সে সুরটি স্বরবিতানের স্বরলিপি অনুসারী নয়। পরে জানা গেল শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া একটি গ্রামোফোন রেকর্ডের সুরেই গানটি এ দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে খেয়াল করে শুনলে বোঝা যায়, হুবহু সেটিও নয়।
১৯৭১ সাল। আমরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কণ্ঠে সেই গান, ‘আমার সোনার বাংলা’। সেই সময় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হয়ে আসা সংগীতশিল্পীদের নিয়ে কলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় গঠিত হয় ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। সৌভাগ্য হয়েছিল আমার সেই সংস্থার এক কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে কাজে যুক্ত হওয়ার। সেই সময় রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক ও স্বরলিপিকার সর্বমান্য শৈলজদা—শ্রী শৈলজারঞ্জন মজুমদার বারবার বলেছিলেন সংস্থার অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তি ওয়াহিদভাইকে (প্রয়াত সংগীতগুণী ওয়াহিদুল হক)—‘তোমরা আমার সোনার বাংলার সুরটি ঠিক করে নিচ্ছ না কেন? এখনো তো সময় আছে।’ পূর্ণ বিজয় তখনো বাকি ছিল। কিন্তু তখন যুদ্ধরত জাতির প্রবাসী সরকার বা সংশ্লিষ্টজনদের যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটিয়ে একাডেমিক বিতর্কে মন ও সময় দেওয়ার অবকাশ ঘটেনি।
যা হোক, স্বাধীনতার পরও আবার সঠিক স্বরলিপি ও শুদ্ধ সুরের প্রসঙ্গটি উঠল। যে সুরটি আমরা গাই সেটি স্বরবিতানে নেই। এ সময় বিশ্বভারতী বাংলাদেশকে উপহারস্বরূপ দেওয়ার জন্য ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকৃত স্বরলিপিটি ১০ হাজার কপি ছাপিয়েছিলেন। পরে তাঁরা যখন জানতে পারলেন, আমরা যে সুরটি গাই, তা ওই স্বরলিপি অনুযায়ী নয়, শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া রেকর্ডের মতো, তখন সেই মুদ্রিত স্বরলিপি পাঠানো স্থগিত করা হয়। শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্র গীত ১৯৪৮-এ প্রকাশিত গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসারে শ্রী শান্তিদেব ঘোষকৃত স্বরলিপি (স্বরলিপি পত্র: ফাল্গুন ১৩৭৮) পুনরায় ছেপে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল বলে জেনেছি। এই স্বরলিপিটি ৪৬ নং স্বরবিতানে সুরভেদ/ছন্দোভেদ অংশে পরে সংযোজিত হয়। তবে আবার বলব, খেয়াল করে শুনলে ধরা পড়বে যে সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরের থেকে আমাদের গায়নে ভিন্নতা আছে। এখানে শান্তিদেব ঘোষকৃত সেই স্বরলিপির সঙ্গে আমাদের গায়নের কিছু বিচ্যুতি উল্লেখ করছি—
১. ভালোবাসি শব্দটির ভালো রস রসা র পরিবর্তে শুধু রা সা বা সা গাওয়া হয়।
বাতাস সুরটি মূল সুরে পধা পম -া।
বা তা০ স।
কিন্তু আমাদের জাতীয় সংগীতে গাওয়া হয় ধা পা -মা।
বা তা স্
২. ‘ও মা’ শব্দটির ‘মা’ শুধু র্সা সুরে গাওয়ার নির্দেশ আছে। কিন্তু ‘মা’ সুরটি র্সর্রা গাওয়া হয়।
৩. মা তোর মুখের বাণী অংশে মুখের বাণী মূল সুরে দুবারই একই রকম অর্থাৎ মা মগা । মা ধা -া । ধা—না ।
মা তোর । মু খে ০ । র্ বা ণী । গাওয়ার নির্দেশ আছে।
আমাদের গায়নে দুবার দুই রকম গাওয়া হয়। অর্থাৎ প্রথমবার মা গা । মা ধা — । ধা ধা - না ।
মা তোর । মু খে র । বা ণী— । এ রকম গাওয়া হয়।
এ রকম আরও কয়েকটি বিচ্যুতি আছে। এসব বিচ্যুতির কারণে গানটিতে বাউল সুরের যে বিশেষ ভঙ্গি আছে, তা ব্যাহত হয়।
কোন স্বরলিপিটি প্রামাণ্য সুর হিসেবে গৃহীত হবে—প্রশ্ন সেটিই। এ গানটির প্রথম সুরটি শুনলে ও ইন্দিরা দেবীকৃত স্বরলিপি দেখলে এবং সেই সুরে পুরো গানটি শুনলে বোঝা যায়, সবটাতে একটা সামঞ্জস্য ও সংগতি আছে এবং এটিতে মূল গান অর্থাৎ ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরের ছাপ স্পষ্ট। তবে শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরটিও বিশ্বভারতী স্বীকৃতি দিয়েছে এবং স্বরবিতানে সংযোজিত হয়েছে। অতএব সেটি গ্রহণ করতে নীতিগত অসুবিধা নেই বলে মনে করি। সেই সুর আমাদের গায়নের কাছাকাছি বলে সেটি মুদ্রণে বা গায়নে সংশোধন করে নিতে বেগ পেতে হবে না।
কিন্তু সমস্যা তাতেও কাটে না। কারণ জাতীয় সংগীত হিসেবে এখন যে সুরটি গাওয়া হয়, সেটি সর্বত্র এই স্বরলিপি অনুযায়ীও নয়। ফলে সুর বিচ্যুতির এক জটিল আবর্তে যেন আমরা পড়ে গেলাম। যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, স্বরলিপি বিচ্যুতির ব্যাপারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ভীষণ আপত্তি জানিয়ে গেছেন তাঁর লেখায়, তখনো কি আমরা নিশ্চেষ্ট বসে থাকব? যুদ্ধের একটা জরুরি তাৎক্ষণিক চাহিদা থাকতে পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। সে বাস্তবতায় প্রয়োজনসাধনই মুখ্য, এমনকি একমাত্র বিষয় হতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় রাষ্ট্রের সব কাজ যেমন আইনানুগ হওয়া উচিত তেমনি জাতীয় সংগীতও তার প্রামাণ্য স্বরলিপি অনুযায়ীই গীত হওয়া উচিত। তাই মনে করি, আমাদের এ ভ্রান্তি শুধরানো প্রয়োজন। ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করা যেমন দরকার, তেমনি সুর-বিকৃতির হাত থেকে জাতীয় সংগীতকে রক্ষা করা জরুরি। কাজটি কঠিনও নয়। কেবিনেট মিটিংয়ের একটি সংশোধনী সিদ্ধান্তই এটি করে দিতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে কবির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও ঋণ শোধের এ হবে এক যথার্থ প্রকাশ। আর আগামী ৪০তম স্বাধীনতা দিবসে পুরো জাতি সঠিক সুরে জাতীয় সংগীতটি গাইতে পারলে তা হবে বাংলাদেশের সত্য পথযাত্রায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
শীলা মোমেন: শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী।

No comments

Powered by Blogger.