লিবিয়া-ভেতরে নৈরাজ্য, সীমান্তে আতঙ্ক by রবার্ট ফিস্ক

অভিবাসন ফাঁড়ির খোলা জানালা দিয়ে কিছু লিবীয় ঝুঁকে দেখছিলেন পলায়নপর ২০ হাজার মিসরীয়, বাংলাদেশি, চীনা ও ইরানি শ্রমিক সীমানাপ্রাচীরের কাছে জড়ো হয়েছেন। ফাঁড়ির লোকদের অনেকটাই নির্বিকার মনে হলো—তাঁদের শার্টের হাতা গোটানো, ভিড়ের কাছাকাছি জানালায় এসে তাঁরা দেখতে থাকলেন।


ইতিমধ্যে ৭৫ হাজার মানুষ তিউনিসিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তবে মঙ্গলবার তিউনিসিয়ায় ঢোকার ব্যবস্থায় ধস নামল, যখন গাদ্দাফির রাষ্ট্র ত্যাগ করতে মরিয়া হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় তিউনিসীয়দের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। তিউনিসীয়রা সেনাবাহিনীর চোখের সামনে লাঠি ও লোহার রড হাতে উদ্বাস্তু আরবদের ওপর হামলে পড়েন।
উদ্বাস্তুদের ভিড়ে পানির বোতল ও বিস্কুট ছুড়ে দিচ্ছিলেন বেশ কিছু সেনাসদস্য। উদ্বাস্তুরা মরিয়া হয়ে সীমানাপ্রাচীর টপকানোর চেষ্টা করছিলেন, পরিবারের সদস্য ও মালামাল সিমেন্টের ভাঙা অংশ দিয়ে পার করে নিতে চেষ্টা করছিলেন। এমন বিশৃঙ্খলা ও অনর্থক যন্ত্রণার মুখে ক্লিশেও ফুরিয়ে যায়। মঙ্গলবার মনে এল ‘দুঃসহ’ শব্দটা। এই ২০ হাজার মানুষের বেশির ভাগই চার দিন ধরে খাদ্য, পানি অথবা নিদ্রাবঞ্চিত। এক সীমান্ত ফাঁড়িতেই মানুষকে কেন এত দুর্ভোগে পড়তে হবে? এমন কেন হয়?
কর্মকর্তারা বলে গেলেন সান্ত্বনাসূচক কিছু কথা—সবই ভয়ানক অপ্রাসঙ্গিক। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক জোসেত্তে শিরান মানুষের এই মহাসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি—এই পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছি। আর এ কাজে কখনোই খুব দেরি হয়ে যায় না।’ কিন্তু দেরি তো হয়েছে। শিরান এলেন ৮০ টন খাদ্য নিয়ে—বেশির ভাগই উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ বিস্কুট। প্রাচীরের ওপারে জনতার উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল সেই বিস্কুট।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের ফিরাস কায়াল তাকিয়ে দেখলেন, মিসরীয় উদ্বাস্তুদের পেটাচ্ছে তিউনিসীয় তরুণেরা। তিনি বললেন, সীমান্তে সংকট তৈরি হয়েছে। আর আগের ১২ ঘণ্টাতেই ১৪ হাজার উদ্বাস্তু সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘তিউনিসীয়রা সহায়তা করার সামর্থ্যের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছেন। তিউনিসিয়ার ভেতরে এসব মানুষের জন্য আজ আমরা জাতিসংঘের দুটি ফ্লাইটে তাঁবু নিয়ে আসছি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনগণকে এই বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সহায়তা করছি।’ কায়াল সাহেব অবশ্য বলেননি যে উদ্বাস্তুদের যারা পেটাচ্ছিল তারা ‘স্থানীয় জনগণ’।
সারা দিন ধরে ফটকের ওপর যখন মানুষের চাপ পড়ছিল, তখন পেছনের হাজারো মানুষের পাশবিক গর্জন বেরিয়ে আসছিল। সীমানাপ্রাচীর টপকিয়ে কয়েকজন অচেতন মানুষকে নিয়ে আসা হলো। বালু ও রাস্তার ওপর তাঁদের পাশাপাশি রাখলেন তিউনিসীয় চিকিৎসকেরা। পানির ঝাপটা আর সেবিকাদের মালিশে তাঁদের জ্ঞান ফিরল। কয়েকজন পথের ওপরই বসে থাকলেন, মাথা দুলিয়ে কাঁদতে থাকলেন। সন্ধ্যা নামার আগে আগে ফটকে উঠে পড়েছিল তিউনিসীয় সেনাবাহিনী। আক্ষরিকভাবেই লিবিয়ার কয়েক গজ ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল তিউনিসীয় বাহিনী, প্রাচীর বরাবর কাঁটাতার বিছিয়ে দিতে। সন্ধ্যা নাগাদ নিকটবর্তী শিবিরকে উদ্বাস্তু নগরে পরিণত করল তিউনিসীয় কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যেও যে নৈরাশ্য ছিল না, এমন নয়। এক চিকিৎসক শাণিত কণ্ঠে আমাকে বললেন. ‘তিউনিসীয়রা যখন নৌকায় চড়ে দক্ষিণ ইউরোপে গিয়ে পৌঁছে, তখন আপনারা বলেন সংকট। কিন্তু যখন হাজার হাজার মিসরীয় লিবিয়া থেকে আমাদের সীমান্তে ঢুকে পড়ে, তখন আপনারা তাদের বিস্কুট দেন—ভুলে যান আমাদের কথা।’
মঙ্গলবারের করুণ কাহিনিগুলোর মধ্যে আদেল জুমার বলা গল্পের চেয়ে নির্মম ছিল না কোনোটাই। এই লিবীয় তরুণ দক্ষিণ তিউনিসীয় সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছেন। তিনি বললেন, লিবীয় বিশেষ বাহিনীর চেক পয়েন্ট, সরকার-সমর্থকেরা জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলি করে মারা, পশ্চিম লিবিয়ায় যাঁরা কর্নেল গাদ্দাফি থেকে রেহাই পেতে চান কিন্তু নিরস্ত্র ও ঘর ছেড়ে যেতে ভীত, তাঁদের কথা। বিদেশি টেলিভিশন স্টেশনের সঙ্গে যাঁরা টেলিফোনে কথা বলেছেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বললেন, ‘ত্রিপোলির এ দিকটায় বড় একটা সেতু আছে। পূর্বমুখী কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়ে রেখেছেন গাদ্দাফি। নিরাপত্তাকর্মীরা রোড ব্লকে আমার গাড়ি পরীক্ষা করেছেন ১৫ বারের মতো। তাঁরা টেলিফোন স্মার্ট কার্ড, পিন কোড কিংবা যোগাযোগের অন্য কোনো উপকরণের তালাশ করছিলেন।’
এই পরাবাস্তব ভয়াবহ অবস্থা আমার সামনে খুব ভালোভাবে ফুটে উঠল, মঙ্গলবার যখন আমি গাড়ি চালিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ফিরছিলাম। ত্রিপোলি থেকে প্রচারিত রাষ্ট্রীয় রেডিও সম্প্রচার শুনছিলাম। অ্যাবাসার্ডের ছাত্রদের জন্য এখানে কিছু মালমসলা মিলবে। প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা দিয়েছেন, বেনগাজির নিয়ন্ত্রণে আল-কায়েদা। ‘লিবিয়ার জনগণ’ জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দা জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার এক ‘রাজা’ গাদ্দাফিকে টেলিফোন করেছেন। ‘সুপরিচিত এক গোষ্ঠীর’ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বিপ্লবী কমিটি জনগণকে সুরক্ষা দেবে। সাম্প্রতিক ‘গোলযোগ’ তদন্ত আর কেন বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো লিবিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে, তা খুঁজে বের করতে একটি স্বাধীন লিবীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। লিবীয় জনগণ তাদের বিপ্লব এবং প্রাণপ্রিয় নেতার অর্জন ও ঐতিহাসিক নেতৃত্ব রক্ষা করতে পেরে খুশি। ‘যারা যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বর হামলা চালিয়েছিল তারাই বেনগাজিতে হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ চালাচ্ছে’। হ্যাঁ, যেসব ইমাম প্রাণপ্রিয় নেতার সমালোচনা করেছেন আর যেসব বিদেশি সংবাদমাধ্যম মহান নেতার নিন্দা করছে, তাদের নিন্দা জানিয়েছেন এক ইমাম। তারপর টেলিফোনে ‘বেনগাজি থেকে এক প্রতিবেদক’ লিবিয়ার জনগণের ওপর আল-কায়েদার নিষ্ঠুরতার বর্ণনা করেছেন।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.