ইউরোপের চিঠি-সৌর প্যানেলের বিশ্ববাজার ও বাংলাদেশ by পিটার কাস্টার্স

বিশ্বের বড় দুই শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা দ্রুত বাড়ছে। মাত্র কয়েক মাস আগে বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখল, তাইওয়ানের উত্তর-পূর্বে কয়েকজন চীনা জেলে ও জাপানি সীমান্তরক্ষীদের মধ্যকার এক ছোট ঘটনা রাতারাতি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধে রূপ নেয়।


বিরোধ ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে বিরল ধাতু বা রেয়ার আর্থ মেটালস রপ্তানিতে চীনের ক্রমবর্ধমান অনীহা। বিরল ধাতু নামের একশ্রেণীর কাঁচামালের কথা হঠাৎ করেই বিশ্ববাসী জানল। এর ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমা বিশ্বের নয়, চীনের। এ ধরনের কাঁচামাল রপ্তানির ওপর চীন বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, এ আতঙ্ক বহু দূর গড়াল—ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসেও অনেকে নড়েচড়ে বসলেন। সে ঘটনা ও বিরোধের পর পাঁচ মাস চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধ আজ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক খবরে জানা যায়, গত বছরের শুরু থেকে মার্কিন সরকারি বন্ড কেনা বন্ধ করে দিয়েছে চীন। এমনকি তাদের অধিকারে থাকা বন্ডের পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ঋণের অর্থসংস্থান করতে বছর শেষে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করত। দরকার পড়লেই চীনের বিপুল ডলার রিজার্ভের ওপর নির্ভর করতে পারত। চীনের এই বিপুল রিজার্ভ গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য-উদ্বৃত্তের ফলে। তাই চীন বন্ড ক্রয় বন্ধ করে দেওয়া মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য আতঙ্কের। তা ছাড়া চীনা কোম্পানিগুলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রস্তুতকারক হয়ে ওঠাও পারস্পরিক উত্তেজনার আরেক কারণ।
নব্বইয়ের দশকে চীনা কোম্পানিগুলো মূলত কম দামি পণ্য (যেমন তৈরি পোশাক) রপ্তানি করত। কিন্তু আজ উচ্চ প্রযুক্তির ও সৃজনশীল পণ্যের প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে দ্রুত আবির্ভূত হচ্ছে চীন। বিশ্ব অর্থনীতি রূপান্তরের জন্য অপরিহার্য খাতগুলোতেও (যেমন সৌর প্যানেল খাত) চীন অতি দ্রুত এগিয়ে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বড় অঙ্গরাজ্যের সৌর প্যানেল বাজারের ৪০ শতাংশ চীনা প্রস্তুতকারকদের দখলে। নতুন ধরনের সৌর প্যানেল নিয়ে এসে বাজারে জায়গা করে নিতে কঠিন প্রতিরোধের মুখে পড়েছে স্থানীয় মার্কিন কোম্পানিগুলো। ইউরোপীয় বাজারও সয়লাব চীনা প্রস্তুতকারকদের পণ্যে। আগে এখানে ছিল জার্মানির প্রাধান্য। এই তীব্র প্রতিযোগিতা অবধারিতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে সরকারি পর্যায়েও। তাই মার্কিন সরকার অভিযোগ তুলেছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোকে চীন স্বল্প খরচে ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে, যা স্পষ্টত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী করা যায় না। তবে চীনের ভর্তুকিবিষয়ক পুরো বিতর্কটাই কিছুটা অযৌক্তিক ঠেকে। কেননা, সৌর প্যানেলের বাজার বিকাশের জন্য পশ্চিমা বিশ্বেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক পদক্ষেপ ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জার্মানির উদাহরণ দেওয়া যায়। ‘ফিড-ইন-ট্যারিফ’ নামের শুল্ক-ব্যবস্থার মাধ্যমে জার্মানি অব্যাহতভাবে বিকল্প জ্বালানিপ্রযুক্তি উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়ে গেছে। সেই ব্যবস্থাধীনে সৌর প্যানেল ও বায়ুশক্তিচালিত টারবাইন প্রস্তুতকারকদের বিশেষ দর প্রদান করা হয়, যা দিয়ে তারা উৎপাদন-ব্যয় মেটাতে পারে। নয়া উদার পন্থার সমালোচকেরা যুক্তি দেখান, আমরা যদি জ্বালানির অতি দূষণমূলক উৎস থেকে বিশ্ব অর্থনীতির দ্রুত উত্তরণ ঘটাতে চাই, তাহলে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ অপরিহার্য।
আরেক ধরনের প্রশ্ন আছে, যা সাধারণত তোলা হয় না কিন্তু তোলাটা জরুরি। সেটা হলো: সৌরশক্তিতে রূপান্তর আসলে কী মাত্রায় সবুজ অর্থনীতিতে যাত্রার ইঙ্গিত দেয়। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য সৌর প্যানেল রিসাইকেল-প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতায় নজর দেওয়া কাজের হতে পারে। জার্মান দূরদর্শী কোম্পানিগুলো নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগ থেকেই রিসাইকেল-পদ্ধতির ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বৈজ্ঞানিক লেখাপত্রে বলা হয়, ‘পরিত্যক্ত সৌর মডিউলের বৃহত্তম ভাগাড়’ জার্মানির ফ্রেইবার্গ শহরে অবস্থিত। সেখানে তিনটি মৌলিক পর্যায়ে পরিত্যক্ত সৌর মডিউলগুলোকে পরিকাঠামোসহকারে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রথমে অ্যালুমিনিয়াম সংগ্রহ করার জন্য পরিকাঠামো খুলে নেওয়া হয়। তারপর গ্লাস-গ্লাস মডিউল ক্রমানুসারে সজ্জিত চুল্লির ওপর ফেলে মডিউলের গায়ে লেগে থাকা প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়। এ প্রক্রিয়াটি প্রচণ্ড জ্বলানিঘন, তাই প্রশ্নসাপেক্ষ। তৃতীয় পর্যায়ে মডিউলের ভেতরকার ভাঙা সিলিকনের ওপর রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। এটা করা হয় পানি, এসিড ও অ্যালকাইন মিশ্রিত দ্রবণে সিলিকন এচিংয়ের মাধ্যমে। সিলিকন পরিষ্কার করার পর রয়ে যাওয়া তরল নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ বর্জ্য-ভাগাড়ে। তাই সৌর প্যানেল রিসাইকেল করার মূল উদ্দেশ্য যেখানে কাঁচামাল পুনরুদ্ধার এবং বর্জ্য-অবশেষ জমে যাওয়া ঠেকানো, সেখানে এ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নতুন ধরনের বর্জ্য পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, সৌর প্যানেল প্রস্তুতকারকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা তীব্রতর হওয়ায় আগে যে ধরনের দ্রব্য ব্যবহার করা হতো, এখন সেগুলোর চেয়ে ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই শিল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে আলোকভেদ্য স্ফটিকসদৃশ মডিউল ব্যবহারের প্রচলন ছিল। কিন্তু ইদানীং এসব মডিউলের পাশাপাশি ‘থিন ফিল্ম’ নামে পরিচিত নতুন একধরনের মডিউল এসেছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ভুঁইফোড় কোম্পানিগুলো কর্তৃক ব্যবহূত থিন ফিল্ম মডিউলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ক্ষতিকর বর্জ্যবিষয়ক সমাজকর্মীদের একটি জোট। এ ক্ষেত্রে ক্যাডমিয়ামের কথা বলা যায়। এটি মানুষের জিনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এবং ক্যানসারের কারণ। ক্ষতিকর দ্রব্য-সম্পর্কিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক নির্দেশনায় ক্যাডমিয়ামকে নিষিদ্ধ করা হয়। আরেকটি উপাদান হলো ইনডিয়াম। টেলিভিশনের চ্যাপ্টা স্ক্রিন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে এটা ব্যবহূত হয়। টেলিভিশনের ওপর চালানো বিদ্যায়তনিক গবেষণায় ফুসফুসের রোগের সঙ্গে ইনডিয়ামের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, টেলিভিশন, কম্পিউটার ও অন্য যেসব ইলেকট্রনিক পণ্যে ক্ষতিকর উপাদান বিদ্যমান, সেসবের পর সৌর প্যানেলই কি ‘পরবর্তী ইলেকট্রনিক-বর্জ্য’। বিকল্প শক্তির জন্য ব্যবহূত সৌর প্যানেল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার এই সময়ে মনে রাখা দরকার, আমরা কেউ পরিবেশগত ঝুঁকির বাইরে নই।
পরিশেষে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করি। মানবজাতি যদি জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে চায়, তাহলে এমন এক অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হতে হবে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আর নির্ভর না করে বরং জ্বালানির বিকল্প ধরনের ওপর নির্ভর করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শিকার হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ সময়মতো অর্থনীতির উত্তরণের ব্যাপারে প্রচণ্ড আগ্রহী। কিন্তু তাতেও কি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের পর্যাপ্ত নিশ্চয়তা আছে? নাকি এবারও বাংলাদেশ ও গরিব দুনিয়া ক্ষতিগ্রস্তের কাতারে শামিল হবে? এ ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখতে হবে। বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনৈতিক কাঠামোতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর স্বাভাবিক প্রবণতা হলো তাদের বর্জ্য-অবশেষ (এর বড় অংশই) রপ্তানি করে দেওয়া। ইলেকট্রনিক-বর্জ্যের ক্ষেত্রে তা ভালোমতোই ফুটে ওঠে। পরিত্যক্ত কম্পিউটার ও টিভি স্ক্রিনের প্রধান আস্তাকুঁড় হিসেবে ব্যবহূত হয় দুনিয়ার প্রান্তিক ও প্রায়-প্রান্তিক দেশগুলো (বিশেষত আফ্রিকার রাষ্ট্রসমূহ ও চীন)। বর্জ্য ফেলার জায়গা হিসেবে বাংলাদেশও বাদ পড়ে না। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জাহাজ ভাঙার কথা ভাবলেই তা ভালোমতো চোখে পড়ে। অর্থনীতিতে এমন এক বাস্তব উত্তরণ ঘটাতেই হবে, যা কেবল জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে বিকল্প জ্বালানিনির্ভরতায় যাত্রা নয়, তারও অধিক। দুনিয়াব্যাপী সৌরশক্তি উৎপাদন বিস্তারের যে পরিস্থিতি এখানে তুলে ধরা হলো তা থেকে স্পষ্ট, ‘সবুজ অর্থনীতি’তে উত্তরণের কোনো সহজ রাস্তা নেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক, বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ ও প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.