শুঁটকির বাজারের বিড়াল চৌকিদার! by ফজলুল বারী

বিড়াল নামের প্রাণীটা বুঝিবা খুব প্রিয় আমাদের সুরঞ্জিত দাদার! শেয়ার কেলেংকারি নিয়ে যখন নির্লিপ্ত-নিশ্চুপ সরকার, সে কেলেংকারির নেপথ্য কুশীলব হিসাবে অভিযোগের তীর যখন বহুল আলোচিত ‘দরবেশ-চাচা’ তথা সালমান এফ রহমানের দিকে তাক করা, তখন তাকেই শেয়ার মার্কেট তদারকির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়।

সেই সিদ্ধান্তকে ভর্ৎসনা করে দাদা তখন বিষয়টিকে ‘শুঁটকির বাজারে বিড়াল চৌকিদার’—এর সঙ্গে তুলনা করে বক্তৃতা দিলেন। আমরা সবাই বললাম, বাহ! দেশের মানুষের বিবেকের সুরেই কথা বলেছেন আমাদের দাদা! তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ নাসিম--এরা প্রায় প্রতিদিনই নানা ইস্যুতে বক্তৃতা দিয়ে জাতির বিবেকের প্রতিধ্বনি করতেন। শেখ হাসিনা মন্ত্রিত্বের ইনাম দিয়ে সুরঞ্জিত দাদা, ওবায়দুল কাদেরের মুখ বন্ধ করেছেন। এখনও মাঝেমধ্যে অপ্রিয় সত্য বলে যাচ্ছেন মোহাম্মদ নাসিম।
মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়েই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বললেন, রেলের কালো বিড়ালটাকে থলে থেকে বের করাই তার কাজ। রেলে কী করে দুর্নীতি-লোকসান হয়, তা তিনি বের করে ছাড়বেনই! আমরা তখন আবার খুশি হয়ে ভাবলাম, বাহ, দাদার মতোই শপথ আর কথা! কারণ সারা দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক গণপরিবহন রেলওয়ে শুধু দুর্নীতির কারণেই আমাদের দেশে ছারখার-বিবর্ণ! কিন্তু কী দূর্ভাগ্য আমাদের, রেলের দুর্নীতির কালো বিড়ালটা কীনা ধরা পড়লো আমাদের সুরঞ্জিত দাদা’র এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িতে! রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের জিএম ইউসুফ আলী মৃধাসমেত নিয়োগ-দুর্নীতি বাণিজ্যের বস্তাভর্তি সত্তুর লাখ টাকা নিয়ে দাদার জিগাতলার বাড়ি যাচ্ছিলেন এপিএস। ভাগাভাগির গোলমালে ড্রাইভার আজম ঘটনা ফাঁস করে দেয়; তাতে এখন শুধু সুরঞ্জিত দাদা’র না, সরকারেরও আমছালা দুটিই যাবার যোগাড়! আমাদের দরবেশ-চাচা সালমান এফ রহমান এখন উল্টো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেই ‘শুঁটকির বাজারের বিড়াল চৌকিদার’ বলে হাত-পা ছুড়ছেন কীনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।

বৃহস্পতিবারের জাতীয় পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে আমার প্রিয় বেশকিছু চট্টগ্রামবাসী সাংবাদিকের অনেক অনুসন্ধানী রিপোর্ট আছে। রেলের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে কী পরিমাণ টাকার হরিলুট চলছিল সেসবের বিস্তারিত বিবরণ আছে  রিপোর্টগুলোতে। সরকার প্রতিটি পরিবারের একজনকে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে; তার সরকার এখন পর্যন্ত কত মানুষকে চাকরি দিয়েছে সে বৃত্তান্ত প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ফলাও করে বলেন। কিন্তু এসব চাকরি যে কী প্রক্রিয়ায় দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছিল, এবার দাদাবাহিনীর কেলেংকারিতে তার গোমর ফাঁস হয়ে গেছে! এমনিতে এখন আমাদের অভাগা দেশের নিয়তি হচ্ছে, টাকা ছাড়া কোথাও চাকরি নেই। আগে বলা হতো, মামা-চাচা ছাড়া চাকরি হয় না। এ তত্ত্বটি এখন বাতিল-পুরনো।

এখনকার বাস্তবচিত্রটি হচ্ছে, টাকা ছাড়া চাকরি হয় না। ভাগ্নেরা টাকা দেবে না বা ভাগ্নেদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া যাবে না বলে আজকাল মামারাও চাকরি দেয় না ভাগ্নেদের! গত বিএনপি আমলে দেখেছিলাম, কোথাও পাঁচটা চাকরি থাকলে বিএনপির স্থানীয় নেতারা চাকরি দেবার কথা বলে দলের পাঁচশ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিচ্ছিলেন! এই রাগে-দু:খে গত নির্বাচনে প্রতারিত ৪৯৫টি বিএনপি পরিবারই বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল! গত নির্বাচনে এভাবেই বিএনপির আজান দিয়ে তারা ম্যান্ডেট ফেলেছিল আওয়ামী লীগের বাক্সে। কিন্তু সেই ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগও যে মোটেই ফেরেস্তার মতো কাজ করছিলো না তা অনেকেই তলে তলে টের পাচ্ছিলেন। সুরঞ্জিত-কাণ্ড ধরা পড়ার পর আড়ালে আবডালে নিয়োগদুর্নীতি টের পাওয়ার বিষয় হয়ে থাকলো না, বরং এর একটি ডকুমেন্টারি-প্রমাণ তৈরি হয়ে গেছে।

মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলন বা বিফিং করে দুর্নীতি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এরও আগে তার এই দুর্নীতি লুকানোর চেষ্টার সঙ্গে বিপজ্জনকভাবে বিজেবি বা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জড়িয়েছেন! মধ্যরাতে বিজেবির নিজস্ব একটি এলাকার একদল আনওয়ান্টেড লোক ঢুকে পড়লো, তাদের সঙ্গে পাওয়া গেল অবৈধ টাকার বস্তা, আর বিজেবি আইন মোতাবেক তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিলো না; আনওয়ান্টেড লোকগুলো আবার টাকার বস্তা নিয়েই দিব্যি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। এর মাধ্যমে দেশে আইনের শাসনের কী নজির দেখা গেল? বিজেবির এই লোকগুলো যদি এরপর দেশের ভিতরে অথবা সীমান্তে বেআইনি কিছু করে, তাদেরকে তখন আমরা কী আর দায়ী করতে পারবো?

চট্টগ্রাম থেকে রেলওয়ের নিয়োগ-দুর্নীতি বাণিজ্যের খবর বানের মতো আসছিল, এই দুর্নীতি ধরা পড়ার পর জানা গেল দুর্নীতির অভিযোগটি আগে সেখানকার দুর্নীতি দমন কমিশন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোথাও থেকে কোনো প্রতিকার দেওয়া হয়নি। রেলের জিএম তার শ্যালক-দুলাভাইকে নিয়ে সেখানে সিন্ডিকেট করে টাকা তুলছিলেন, ঢাকা আসার সময় দুর্নীতির বখরার টাকার বস্তা সঙ্গে থাকায় সেখানে তাকে প্রহরা দিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়া হয়েছে, মধ্যরাতে মন্ত্রীর বাড়িতে যাবার সময়ও তার সঙ্গে ছিলেন রেল পুলিশের কমান্ডেট একজন! আর মন্ত্রী মিডিয়াকে বললেন, এগুলো তার এপিএসের ব্যক্তিগত টাকা! বুধবার আবার সেই এপিএসকে বরখাস্তও করা হয়েছে! এভাবে ধারাবাহিক দুর্নীতি লুকানোর চেষ্টা থেকে প্রমাণ হয়ে গেছে মন্ত্রী সুরঞ্জিতের দুর্বলতা। এর দায় তাকে নিতেই হবে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুরস্ক যাবার সময় নাকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে পদত্যাগ করতে বলে গেছেন! প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, তিনিতো(সুরঞ্জিত) ডুবেছেনই, সরকারকেও ডুবিয়েছেন! প্রধানমন্ত্রীর উপলদ্ধি যদি সত্য হয়, তাহলে বলবো তা জাতির অন্ধকার আকাশে তা একটি আলোর রেখা। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিত্য লম্বা বক্তৃতা চললেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে সত্যিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়, সে বিশ্বাস ও আস্থা দেশের মানুষ বেমালুম হারিয়ে ফেলেছে! এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদি পদত্যাগ না করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কাজ হবে তাকে বরখাস্ত করা। এর সঙ্গে চট্টগ্রামে রেলওয়ের নিয়োগবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের হেফাজতে আনতে হবে। সেখানে এরই সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সম্পৃক্তি পাওয়া গেলে গ্রেফতার করতে হবে তাকেও। রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ জিএম ইউসুফ আলী মৃধা আর মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুককে শুধু নয়। এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হবে ড্রাইভার আজম। তাই তাকে নিরাপদে সরকারি হেফাজতে রাখা এখন সরকারের ফরজ কাজ। চট্টগ্রামের নিয়োগ-বাণিজ্যের শিকার যারা চাকরির জন্য বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েছেন, তাদের টাকা ফেরত, টাকা দিতে না পারায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যারা চাকরি পাননি তাদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে জোর দিতে হবে এ কারণেই যে, নইলে সরকার তারেকসহ বিএনপির দুর্নীতিবাজদের বিচার ও সমালোচনা করার নৈতিক ভিত্তি হারাবে।

হায় দাদা, আজ আবার লিখছি, ব্যক্তিগতভাবে আপনি আমাকে চেনেন, জীবনে আপনার অনেক স্নেহ পেয়েছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রথম সংবিধান রচনা থেকে শুরু করে এদেশের নানান কিছুতে আপনার যত অবদান, তা এই বুড়ো বয়সে এসে দুর্নীতির অভিযোগে ডুবতে বসেছে! আপনি ভাটির দেশ হাওর অঞ্চলের মানুষ, এর আগে আপনার বিরুদ্ধে হাওর লিজ-বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ লোকমুখে থাকলেও সেগুলোর কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু রেলওয়ের দুর্নীতির কালোবিড়ালটিকে থলের ভেতর থেকে বের করার কথা-বলা আপনার নেতৃ্ত্বের রেলওয়েতেই কিনা গরিব ছেলেমেয়েদের ভিটেমাটি বিক্রি করা টাকায় চললো নিয়োগবাণিজ্য! ধর্মের কলটি যে বাতাসে নড়ে উঠলো দাদা!! এর সব দায় নিজের মাথায় নিয়ে আপনাকে যে এখন এখান থেকে ফেরত যেতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দু:খিত!

পুনশ্চঃ কয়েকদিন আগে আত্মহনন করেছেন আমার প্রথম সম্পাদক, সাংবাদিকতার প্রথম শিক্ষক ও দেশের নতুন ধারার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মিনার মাহমুদ। কিন্তু তার মৃত্যুতে দেশের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেত্রী বা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একটি শোকবিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ মিনার মাহমুদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো না। আমাদের এসব নেতার চাইতে অনেক অনেক ভালো মানুষ ছিলেন মিনার মাহমুদ। আত্মমর্যাদা অটুট রাখতে প্রতিবাদী হয়ে আত্মহনন করেছেন তিনি। আমাদের এসব ভদ্রবেশী মুখোশধারীর মতো মর্যাদাহীন যেনতেনভাবে ছলচাতুরি করে টিকে থাকার চেষ্টা তিনি করেননি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা যত ধরা পড়বেন দেশের মানুষ তত মনে করবে মিনার মাহমুদের মতো একজন সৃষ্টিশীল সৎ মানুষের কথা। নীরবে ফেলবে এক ফোটা অশ্রু।

No comments

Powered by Blogger.