নোবেল বিজয়ীর অসম্মানজনক বিদায় কেন?-মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি

গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, তাঁর নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন অনুসৃত হয়নি।


বিষয়টির যেমন আইনগত দিক আছে, তেমনই আছে সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যও। গ্রামীণ ব্যাংক মুহাম্মদ ইউনূসের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান, যে স্বপ্ন তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের সীমা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে। সে ক্ষেত্রে তাঁর অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকার যে আইনের দোহাই দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে, সেই আইন কি সংশোধনের অযোগ্য?
গ্রামীণ ব্যাংক ভিন্নধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হলেও এর উদ্যোক্তা সরকার নয়, মুহাম্মদ ইউনূস। আর এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার মাত্র ২৫ শতাংশ সরকারের, বাকিটা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ বা অপসারণের এখতিয়ার গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি তাঁকে অব্যাহতি দিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। এর আগে নরওয়ে টেলিভিশনে গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল স্থানান্তর-সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যে তদন্ত কমিটি করেছিল, তার কাজও শেষ হয়নি। সরকার ওই কমিটির রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। এমনকি মুহাম্মদ ইউনূসকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি। এভাবে কাউকে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়া কেবল অসম্মানজনক নয়, অনৈতিকও।
ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা থাকতে পারে। তবে স্বীকার করতে হবে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে। যাঁরা সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণসুবিধা পান না, তাঁদের কাছে সেই সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে এই ব্যাংক। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা অসামান্য অবদান রেখেছে, যার স্বীকৃতিস্বরূপ গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
মুহাম্মদ ইউনূসের অব্যাহতি বা অপসারণের ঘটনাটি দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ফ্রেন্ডস অব গ্রামীণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে আইনবহির্ভূত বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বলেছেন, ‘মুহাম্মদ ইউনূসকে যেভাবে অপসারণ করা হয়েছে, তাতে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন।’ দেশের নাগরিক সমাজেরও প্রশ্ন, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূূসকে অসম্মানজনকভাবে কেন বিদায় দেওয়া হলো? অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও স্বীকার করেছেন, তাঁর অপসারণে দেশের ভাবমূর্তি বাড়েনি।
ইতিমধ্যে মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে নয়জন পরিচালক উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন। মাননীয় আদালত রোববার এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন। আইনগত বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তবে প্রত্যাশা থাকবে, সরকার দেশের ভাবমূর্তি ও গ্রামীণ ব্যাংকের লাখ লাখ গরিব গ্রাহকের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করবে। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সেই কাজ করতে পারে না, যে কাজে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

No comments

Powered by Blogger.