আদায় হয়নি খেলাপি ঋণ-দায় অব্যাহতি চান প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান by মনজুর আহমেদ

বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মোল্লা সোনালী ব্যাংকের এক ঋণের দায় থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। কিন্তু এই ঋণটির পুরো অর্থ আদায় হয়নি, খেলাপি অবস্থায় রয়েছে। সোনালী ব্যাংক ২০০৫ সালে এই ঋণের খেলাপি অর্থ আদায়ে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে।


ক্রেতা হচ্ছে বাজনাবো টেক্সটাইল মিলস, মিসেস ফেরদৌসী ইসলাম ও সায়মা ইসলাম (প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও মেয়ে) এবং আবুল কালাম (অপর জামিনদাতা রওশন আরা খাতুনের স্বামী)। প্রাইম ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বাজনাবো টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
অবিশ্বাস্য কম মূল্যে নিলামে সম্পত্তিগুলো বেচাবিক্রি হয়। অভিযোগ আছে, ২০০৫ সালে সোনালী ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সহযোগিতায় এত কম মূল্যে সম্পত্তি বিক্রি হয়েছে। জানা যায়, ১৯৯৯ সালে সোনালী ব্যাংক বন্ধক নেওয়া সম্পদের মূল্যায়ন করেছিল ১৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর ২০০৫ সালে এসে বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি হয় মাত্র চার কোটি ৪০ লাখ টাকায়।
সোনালী ব্যাংকের কাগজপত্রের তথ্য থেকে দেখা যায়, ’৯৯ সালে ব্যাংকের মূল্যায়ন ছিল ঢাকার পরিবাগ এলাকায় অবস্থিত সাকুরা টেক্সটাইলের যন্ত্রপাতি, প্রকল্প ভবন, তৎসংলগ্ন জমি (২৪৭ দশমিক ৫০ শতাংশ) এবং নরসিংদীতে জমি (১০ দশমিক ৫০ শতাংশ) ও তিনতলা আবাসিক ভবনের (সাত হাজার ৫৬৮ বর্গফুট) মূল্য ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। নিলামে (২০০৫ সালে) এই সম্পদ বিক্রি হয় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকায়। তা কিনেছেন বাজনাবো টেক্সটাইল মিলস। ’৯৯ সালে ঢাকার রমনা এলাকায় ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি ও নির্মাণাদির মূল্য ব্যাংক নির্ধারণ করেছিল দুই কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০০৫ সালে নিলামে ফেরদৌসী ইসলাম ও সায়মা ইসলাম তা ক্রয় করেন এক কোটি ৬০ লাখ টাকায়। আর ঢাকার ডেমরা এলাকায় ৪৬ দশমিক ০৯ শতাংশ জমি ’৯৯ সালে ব্যাংক মূল্যায়ন করে ৭৫ লাখ টাকায়। এই জমি ২০০৫ সালে নিলামে বিক্রি হয় ৪০ লাখ টাকায়, কেনেন আবুল কালাম।
ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, ১৯৯৭ সালে সাকুরা টেক্সটাইল অ্যান্ড ফিনিশিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংকের ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের করপোরেট শাখা থেকে প্রকল্প ও চলতি মূলধন খাতে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ছিলেন দেওয়ান সমীর, তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তার ও ভাই নাজিম উদ্দিন।
২০০০ সালে এসে এই কোম্পানির অনুকূলে চলতি মূলধন বাড়ানো হয়। এ সময় বর্তমান প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ মোট আটজন পুরো ঋণের জামিনদার হন। এ জন্য নতুন করে কিছু সম্পদ বন্ধকও রাখা হয় ব্যাংকের কাছে। পরবর্তী সময় ঋণটি খেলাপিতে পরিণত হয়। ব্যাংক একপর্যায়ে সম্পত্তি নিলামে ওঠায় মামলা দায়েরের প্রাক্কালে।
ব্যক্তিগত জামানত হিসেবে যাঁরা ২০০০ সালে ঋণটির সঙ্গে যুক্ত হন তাঁরা হলেন, খোশনেহার, ডি ফেরদৌসুর রহমান, সেলিনা আক্তার, নাজমা আক্তার, মো. সজীব মিয়া, রিপন মিয়া, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (বর্তমান প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান) ও রওশন আরা খাতুন।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় আজ এই ঋণের দায় থেকে সিরাজুল ইসলাম মোল্লাকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাবটি উঠবে বলে জানা গেছে। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের একাধিক সদস্য এই অব্যাহতিদানের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করছেন বলেও সূত্রগুলো জানায়।
কিন্তু ব্যাংকের আইনজ্ঞের মতামত হচ্ছে, ঋণের ব্যক্তিগত জামিনদাতা সিরাজুল ইসলাম মোল্লাকে ঋণের দায়ভার থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও নিম্ন আদালতের একটি রায় রয়েছে সিরাজুল ইসলামের পক্ষে। আর ব্যাংক ১৪ ফেব্রুয়ারি এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে।
সূত্র জানায়, বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির পর পুরো ঋণে বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। জানা যায়, ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু শাখা প্রধান কার্যালয়কে জানিয়েছে, গ্রহীতাদের কেউ ঋণের বিষয়ে আর কোনো যোগাযোগ করেন না। এমনকি বাকি জামিনদাররাও আর্থিকভাবে ঋণ পরিশোধে সক্ষম নন।
সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জামিনদার সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার বন্ধকি সম্পদ কিনে নিয়েছেন পানির দামে। এখন ঋণের দায় থেকে মুক্তি পেলে ব্যাংকের অর্থ আর আদায় হবে না। কিন্তু ব্যাংকের প্রভাবশালী একাধিক পরিচালক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা চান অব্যাহতি দিতে।
যোগাযোগ করা হলে সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘আমি মূল ঋণগ্রহীতা নই। আবার ব্যক্তিগত জামিনদারও নই। আমি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ঋণের চলতি মূলধন বৃদ্ধির জন্য আমার সম্পদ বন্ধক দিয়েছিলাম। ব্যাংক সে সম্পদ নিলামে বিক্রি করেছে। আমার স্ত্রী ও কন্যা কিছু সম্পদ কিনেছে।’ তিনি দাবি করেন, সাত-আটটা সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে সে সময় নিলামের তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। সে নিলামে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে সম্পদটি ক্রয় করেন।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যাংকের কাছ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। কিন্তু, ব্যাংক উচ্চ আদালতে গেছে। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতে আমারও যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এগুলো করতে গেলে তো অনেক বছর পার হয়ে যাবে। সে জন্যই আমি ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে আমার অব্যাহতির বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে চেয়েছি।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘আমি কখনো ঋণের ব্যক্তিগত জামিনদার হইনি। ব্যাংকের কাগজপত্রে যে স্বাক্ষর রয়েছে, তা আমার নয়। এটা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।’
জানা গেছে, নিম্ন আদালত থেকে যে রায় দেওয়া হয়েছে সেখানে আদালত থেকে মূল কাগজপত্র খোয়া যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.