গদ্যকার্টুন-আমি চিনি গো চিনি তোমারে by আনিসুল হক

বহুদিন আগে এক কলাম লেখক লিখেছিলেন, বাজারে গেলাম, খাসির দরে মুরগি কিনিয়া ফিরিলাম। এই কথা এখনো লেখা যায়, রুই মাছ কিনবেন বলে পকেটে টাকা নিয়ে গেছেন, ওই টাকায় একটা আস্ত পুঁটি মাছ কিনে ফিরেছেন। তারপর ওই পুঁটি মাছটাকেই কয়েক টুকরো করে কেটে তার মাথা, পেটি, লেজ, পুরো পরিবার-পরিজন মিলে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর


তুলতে পারবেন। তো আমাদের সোনার বাংলাদেশে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, জিনিসপত্রের দামও বাড়তে বাধ্য। আমাদের হয়তো খাদ্যগুদামের সংখ্যা ও ধারণক্ষমতাও বেড়ে গেছে। না হলে একদিন দেখা গেল, বাজার থেকে চিনি উধাও। অত চিনি ওরা লুকাল কোথায়? পরের দিন সেই চিনি বেরিয়ে পড়ল, ফিরে এল বাজারে। কারণ কী? গোয়েন্দারা নাকি পিঁপড়ের মাথায় ছোট্ট গোপন ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে সহজেই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে, চিনি কোথায়। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে চিনি নিয়ে একটা ছিনিমিনি খেলা চলবে, তা তো এই বাংলায় স্বাভাবিক। কারণ রবীন্দ্রনাথ চিনি নিয়ে গান লিখেছেন, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী। তুমি থাকো সিন্ধুপারে...। এই গান যে চিনি বা সুগার নিয়ে লেখা, তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের বিদেশি গবেষক এন্ড্রুজ সাহেব একদিন এক অধ্যাপককে বলছেন, জানেন, গুরুদেব সুগার নিয়ে একটা গান লিখেছেন। কী গান? আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী। অধ্যাপক বললেন, কে বলল আপনাকে এই গান চিনি নিয়ে লেখা।
কেন? স্বয়ং গুরুদেব বলেছেন! আমাকে তিনি গানটা শোনালেন। আমি বললাম, গানটা ভীষণ মিষ্টি। গুরুদেব বললেন, চিনি নিয়ে গান লিখেছি, মিষ্টি হতে বাধ্য।
বাজার সত্যি গরম। তার ওপর লোডশেডিং। গিন্নির মেজাজ গরম। গ্যাস মিলছে না, গ্যাসের চুলার নিচে মাটির চুলা বসিয়ে কাঠের লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। তার ওপর সংবাদপত্রের পাতা খুললেই দুঃসংবাদ আর দুঃসংবাদ। এই অবস্থায় আমি ঠিক করেছি, আপনাদের কৌতুক পরিবেশন করব। সব কৌতুকই ইন্টারনেট থেকে নেওয়া, বলা বাহুল্য।
স্বামী অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছেন। স্ত্রী তাঁর পাশে একটা মোড়া নিয়ে বসে আছেন। স্বামীর জ্ঞান মাঝেমধ্যে ফিরে আসে। তিনি চোখ মেলেন। একবার সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে স্বামী চোখ মেললেন। তিনি অস্ফুট স্বরে কী যেন বলছেন। স্ত্রী তাঁর কান স্বামীর মুখের কাছে নিলেন। স্বামী বলছেন, তুমি সব সময়ই সব সংকটে আমার পাশে ছিলে। যখন আমি শেয়ার মার্কেটে ধরা খেলাম, তখন তুমিই ছিলে আমার পাশে। যখন রাস্তায় আমাকে ছিনতাইকারী ছুরি মারল, আমি হাসপাতালের বিছানায় পড়ে রইলাম, তুমিই ছিলে আমার পাশে। যখন পকেটমার ভেবে আমাকে গণপিটুনি দেওয়া হলো, তখনো তুমি ছিলে আমার সঙ্গে। যখন আমার চাকরি চলে গেল, তখনো তুমিই ছিলে আমার পাশে। এ থেকে আমি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছি।
কী? স্ত্রী শুধালেন।
আসলে তুমিই অপয়া। তুমিই আমার জীবনে দুঃখকষ্ট নিয়ে এসেছ। তুমি যেখানে থাকো, সেখানেই দুর্ভাগ্য বয়ে আনো।
বাদ দিন। অকৃতজ্ঞ স্বামীর কথায় আমরা বেশি পাত্তা দেব না। কিন্তু আমাদের কাজ করে যেতে হবে। খুব মন দিয়ে, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। যেমন করেছিলেন একজন মিনিস্টার। আমেরিকার এক ছোট শহরে। এই মিনিস্টার মানে মন্ত্রী নন। বরং পাদরি বা যাজক বলা যেতে পারে। এক মিনিস্টার, তিনি তাঁর জীবনের প্রথম শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা বলছেন। ‘সেটা ছিল আমার প্রথম কাউকে সমাহিত করা। আমাকে খবর দেওয়া হলো, অমুক সমাধিক্ষেত্রে একজন মৃতকে সমাহিত করার অনুষ্ঠানটি আমাকেই পরিচালনা করতে হবে। আমি সেই সমাধিক্ষেত্রের দিকে নিজে গাড়ি চালিয়ে রওনা হলাম। কিন্তু ঠিকানাটা আমার সঠিকভাবে জানা ছিল না। যেহেতু আমি ছিলাম তরুণ, তাই কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করাটা ছিল আমার পক্ষে অবমাননাকর। আমি নিজেই মানচিত্র দেখে ওই সমাধিক্ষেত্র খুঁজে বের করলাম। দেখলাম, কফিন রেডি। সমাধি খোঁড়ার কাজটাও হয়ে গেছে। গোরখোদকেরা তখন দুুপুরের খাবার খাচ্ছে। আমি জানি, এই সমাধিক্ষেত্র খুঁজে পেতে আমার এক ঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আমি বললাম, দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করা উচিত নয়। আমরা কাজটা সারি। গোরখোদকেরা বলল, আমরা খাবারটা খেয়ে নিই। তারপর নামাচ্ছি।
ওরা খেয়েদেয়ে হাত লাগাল। মাটি দেওয়া হয়ে গেলে আমি বললাম, আসো, আমরা এখন এই মৃতের জন্য প্রার্থনা করি।
ওরা বলল, ওদের এত বছরের অভিজ্ঞতায় এই ঘটনা প্রথম। সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে যন্ত্র নামানোর পরে কেউ কোনো দিনও তাদের প্রার্থনা করতে বলেনি। মিনিস্টার বুঝলেন, তিনি যা করেছেন, সবই পণ্ডশ্রম। তিনি ভুল জায়গায় এসে ভুল কর্মের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আমাদের মিনিস্টারদের আমরা বলতে পারি, সব ঠিকানা আপনাদের জানা না-ও থাকতে পারে। নিজে নিজে পথ চলে ভুল ঠিকানায় হাজির না হয়ে পথে কাউকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে স্থানটা কোথায়। বহু কাজ তাড়াহুড়া করে করে ফেলার পর দেখা যাচ্ছে, কাজটা ঠিক হয়নি। যেমন—সংবিধান সংশোধন কিংবা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করে দেওয়া।
আল গোরের চাচার চাচাকে নিয়ে একটা কৌতুক প্রচলিত আছে। ক্লিনটনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রী জানতে পারলেন, আল গোরের চাচার চাচা ছিলেন ঘোড়াচোর। তার একটা ছবির নিচে লেখা আছে, গান্টার গোর, ঘোড়াচোর। জেলে গেছেন ১৮৮৩ সালে, ১৮৮৭ সালে পালিয়েছেন জেল ভেঙে। ছয়বার সরকারি আস্তাবলে চুরি করেছেন, শেষে ধরা পড়েছেন গোয়েন্দাদের হাতে। বিচার শেষে ১৮৮৯ সালে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এই ফটোটা তুলে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ভাবমূর্তিবিষয়ক পেশাদার পরামর্শকদের হাতে। তাঁরা খুব সুন্দর করে এই ছবি উদ্ধার করে নিচে লেখেন, গান্টার গোর ছিলেন উনিশ শতকের এক বিখ্যাত ঘোড়া বিশেষজ্ঞ। তিনি ১৮৮৩ সালে সরকারের একটা প্রতিষ্ঠানে নিজের মূল্যবান চারটা বছর উ ৎসর্গ করেন, তারপর সেখান থেকে স্বেচ্ছায় সরে আসেন। ১৮৮৭ সালে তিনি সরকারি গোয়েন্দা কাজকর্মের মূল ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৯ সালে তাঁর সম্মানে আয়োজিত একটা সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চটি ভেঙে পড়লে তিনি দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
এই কাহিনি নিতান্তই কাল্পনিক। তবে এ রকম একদল ভাবমূর্তি রচনাকারী পেশাদার বিশেষজ্ঞ মনে হচ্ছে দরকার। যাঁরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ধুলায় লুটিয়ে পড়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে নানা কৌশল অবলম্বন করবেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.