চারদিক-আনারসের গ্রাম by কল্যাণ প্রসূন

মাথার ঠিক ওপরে সূর্য। আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে আমরা (চালকসহ নিজে) মোটরসাইকেলে ছুটে চলেছি আনারসের বাগান দেখতে। গ্রামটির নাম বাহাদুরপুর। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সদর জায়ফরনগর ইউনিয়নে এটির অবস্থান। গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছাতেই মধ্যবয়সী চার-পাঁচজন লোকের দেখা মেলে। শরীর থেকে তাঁদের অঝোরধারায় ঘাম ঝরছে।


তাঁদের প্রত্যেকের কাঁধভারে বাঁশের বেত দিয়ে তৈরি দুটি করে টুকরি। টুকরিগুলোতে আনারস বোঝাই করা। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরের হাটে পৌঁছে তাঁরা সেগুলো বিক্রি করবেন। আলাপচারিতায় জানা গেল, গ্রামের কয়েকজন বাগানমালিকের কাছ থেকে তাঁরা পাইকারি দরে এসব আনারস কিনেছেন। কিছু সময় জিরিয়ে তাঁরা গন্তব্যে পা বাড়ালেন। আমরাও ছুটে চললাম। কিছু সময় পরই বাহাদুরপুর গ্রামে পৌঁছে গেলাম।
পুরো গ্রামটিই ছোট ছোট টিলায় ভরা। এর মধ্যে কয়েকটিতে জনবসতি গড়ে উঠেছে, বাকিগুলোতে ফল-ফলাদির বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে আনারসের বাগান। আর এর ফাঁকে ফাঁকে কাঁঠাল, লটকনসহ বিভিন্ন জাতের লেবুজাতীয় ফলের গাছ। পাকা ফলের ম-ম ঘ্রাণ ভেসে আসে। মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এ যেন এক অন্যরকম দৃশ্য।
স্থানীয় ময়নুল ইসলাম (৬৫) বললেন, ‘ফলের মধ্যে বাহাদুরপুরে আনারসটাই বেশি অয়। ইটা দেখতে ছোট। কিন্তু রসে ভরা। খাইতে মিষ্টি। এর লাগি মানুষজনে ইটারে ‘‘বাহাদুরপুরী আনারস’’ ডাকইন।’ রসালো ও সুমিষ্ট হওয়ায় স্থানীয় এবং আশপাশের হাট-বাজারে এই আনারসের বেশ চাহিদা রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। স্থানীয়রা জানালেন, দেশ স্বাধীনের অনেক আগে থেকেই বাহাদুরপুরে আনারস, কাঁঠাল ও বিভিন্ন জাতের লেবুর আবাদ হচ্ছে। তখন লোকজনের মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা ছিল না। এ ছাড়া আশপাশের এলাকায়ও কম-বেশি ফল-ফলাদি পাওয়া যেত। একসময় আশপাশের এলাকাগুলোর টিলা কেটে জনবসতি গড়ে ওঠে। কমে যায় ফলের আবাদ। কিন্তু বাহাদুরপুরের চিত্রটা খুব একটা পাল্টায়নি। ওদিকে জনবসতিও তেমন বাড়েনি। এখানকার আনারস বাইরের বিভিন্ন হাট-বাজারে গেলে লোকজনের নজর কাড়ে। একপর্যায়ে গ্রামের লোকজন এটি আবাদে আরও উদ্যোগী হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকটি বসতবাড়ির টিলার ভাঁজেও আনারসের আবাদ দেখা যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, বাহাদুরপুরের অন্তত ১০০ একর জমিতে বর্তমানে আনারসের ফলন হচ্ছে। ছোট-বড় বাগান আছে প্রায় ৩০টি। এসব বাগানে আনারসগাছের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। মৌসুমে ২০০-২৫০ জন শ্রমিক সেখানে মজুরি খাটেন।
গ্রামের সবচেয়ে বড় আনারসের বাগানের মালিক মর্তুজ আলী। তিনি কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন তাঁর সন্তানেরা বাগানটি দেখভাল করছেন। ওই বাগানে ঢুকে দেখা গেল, ১০-১৫ জন শ্রমিক পাকা আনারস খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করে টুকরিতে ভরছেন। সেখানে দেখা হয় মর্তুজ আলীর ছেলে দুবাই-প্রবাসী ফখরুজ্জামানের সঙ্গে।
ফখরুজ্জামান জানান, ১৯৬৫ সালের দিকে তাঁর বাবা প্রায় ৩০০ বিঘা টিলা রকমের সরকারি খাসজমি ইজারা নিয়ে সেখানে ফলের বাগান করেন। এর মধ্যে আনারসের সংখ্যাই বেশি। প্রতিবছর ফল পাকার আগে তাঁরা পাইকারদের কাছে বাগান বিক্রি করে দেন। এবার দুই লাখ টাকায় তাঁরা বাগানের আনারস বিক্রি করেছেন। দেশে এলে মাঝেমধ্যে তিনি বাগানে এসে কিছু সময় বেড়িয়ে যান।
আনারসচাষি মো. চিনু মিয়া বলেন, তাঁদের তিন বিঘার বাগানে প্রায় আড়াই হাজার আনারসগাছ আছে। এবার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। এখন মৌসুমের শেষ সময়ের বেচাকেনা চলছে।
আকরাম আলী বলেন, ‘ই এলাকার মাটি ভালা। ফলনও ভালা অয়। কোনো ধরনর রাসায়নিক সার বা ওষুধ ব্যবহার করতে অয় না। বছরে দুইবার খালি আগাছা পরিষ্কার করি দিতে অয়।’
স্থানীয়রা জানান, আশপাশের কুলাউড়া, বড়লেখা, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও রাজনগর উপজেলার ফল ব্যবসায়ীরা বাহাদুরপুর থেকে প্রতিদিন আনারস কিনে নেন। ১০০ আনারস এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়।
তবে গ্রামে প্রবেশের বেহাল রাস্তাটা নিয়ে স্থানীয়দের বেশ ক্ষোভ আছে। তাঁরা জানান, জুড়ী-কুলাউড়া সড়কের ভূঁয়াই এলাকা থেকে বাহাদুরপুর গ্রামে যাওয়ার রাস্তার বেশ কিছু অংশ কাঁচা। তাই বর্ষায় রাস্তাটি কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। তাতে ফল বাজারজাতকরণে সমস্যা হয়। তাঁরা রাস্তার এই অংশ পাকাকরণের দাবি জানান।বাগান থেকে ফিরে কথা হয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বাছিরুল আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, উপজেলার প্রায় ১৮৬ একর জায়গায় আনারসের আবাদ হয়। এর মধ্যে বাহাদুরপুর এলাকায় বাগানের সংখ্যা বেশি। তিনি জানান, বাহাদুরপুরের আনারস ‘হানিকুইন’ জাতের। আকারে ছোট হলেও সুমিষ্ট। ফলন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যায় তাঁরা আনারসচাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী রণজিত কুমার পাল জানালেন, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাহাদুরপুর গ্রামের কাঁচা রাস্তাটির এক কিলোমিটার জায়গা পাকাকরণের সম্ভাবনা আছে।
কল্যাণ প্রসূন

No comments

Powered by Blogger.