ইতি-নেতি-রুমানা মনজুরের চোখ যে সত্যকে উন্মোচন করেছে by মাসুদা ভাট্টি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরকে পিটিয়ে ভয়ংকর জখম করেছে এক দুর্বৃত্ত। সামাজিক সম্পর্কের বিচারে লোকটি রুমানার স্বামী। লোকটি দেশের অন্যতম বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান বিদ্যাপীঠ বুয়েটে লেখাপড়া করেছেন। শিক্ষা মানুষকে যে আলোকিত করে না, তার প্রমাণ হিসেবে এই লোকটিকে অনায়াসে দাঁড় করানো যায়।


কিন্তু সেটা হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়, এর বাইরেও কথা থেকে যায়। রুমানাকে আমরা গণমাধ্যমে দেখছি। দেখে দেখে আমরা যে যার মতো করে ভাবতে শুরু করেছি তাঁর পরিস্থিতি নিয়ে এবং অনেকেই নিজের সঙ্গে মেলাচ্ছেন রুমানাকে। কেউ সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন, কেউ বা সাযুজ্য। রুমানা এই সমাজের বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সঙ্গে বিয়ে নামের সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েও কতটা হিংস্র ও পশুত্বকে ধারণ করেন নিজের মধ্যে। রুমানার সঙ্গে বা যে কারো ক্ষেত্রেই একজনের আরেকজনের সঙ্গে বনিবনা না হতে পারে, মতের অমিল ঘটতে পারে, এমনকি বিতর্কও হতে পারে; কিন্তু গায়ে হাত তোলার মতো নির্মমতা যেকোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই যে গ্রহণযোগ্য নয়, তা আসলে কোনো শিক্ষাই মানুষকে শেখাতে পারে না, যদি মানুষটি নিজে তা উপলব্ধি না করে। সে ক্ষেত্রে সাঈদ নামের এই ব্যক্তিটির শিক্ষা অপরিপক্ব এবং তাঁর জীবনবোধে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে কিংবা আরো একটু এগিয়ে বলা ভালো যে তিনি আসলে অসুস্থ। তাঁর মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, এই মানসিক বিকার কি আমাদের চারপাশে বা সমাজে সর্বত্র দৃশ্যমান নয়? রুমানা মনজুর নামের মেয়েটি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা প্রতিকূলতা পার হয়ে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তাঁকে এ পর্যন্ত পেঁৗছতে যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, তাঁর সমকক্ষ একজন পুরুষ সহকর্মীর প্রতি সব সম্মান রেখেই বলছি, রুমানার ক্ষেত্রে তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। ব্যক্তি জীবনে রুমানা কেমন_সে প্রশ্ন অবান্তর, যে প্রশ্ন অবান্তর তাঁর স্বামী সাঈদের ক্ষেত্রেও। সমাজের বেঁধে দেওয়া সম্পর্ক আসলে ব্যক্তি মানুষের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না, যদিও সমাজ এগিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আজকাল বিয়ের আগে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ পাত্র-পাত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়েও খোঁজখবর করে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত হয়। অন্যদিকে যদি একে অপরকে দেখে-শুনে, জেনে-বুঝে সম্পর্ক স্থাপন করে বিয়ে হয় সে ক্ষেত্রেও জানা-বোঝার মধ্যে পার্থক্য থাকতেই পারে। রুমানা-সাঈদের ক্ষেত্রেও সে রকম বোঝাপড়ার ফারাক রয়েছে, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু সেই পার্থক্য একজন মানুষকে এতটা হিংস্র করে তুলতে পারে, সেটা ভাবলেও ভয় লাগে। প্রশ্ন হলো, সাঈদকে কি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনেক বেশি সাহসী করেনি? করেছে এবং তা কিভাবে_সে বিষয়ে আলোচনা হওয়াটা জরুরি। বাংলাদেশে যেসব ঘটনা গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় সেসবই মূলত আলোচনায় আসে, বাকি সব ঘটনাই অনুল্লেখ্য থাকে। সম্প্রতি একটি রিপোর্টে দেখতে পেলাম, দেশে আত্মহত্যার প্রবণতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং শিকার মূলত নারী। কেন নারী আত্মহত্যা করে? কারণ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্ম তাকে আশ্রয় দেয় না। সে মূলত অসহায়। নারী যে অবলা সে কথা তো আমরা বহু আগে থেকেই শুনে আসছি এবং যেকোনো দুর্ঘটনার খবরে 'নারী ও শিশু'সহ হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণের মতো 'নারী' আসলে ভিন্ন এক পরিচিতি, মানুষের কাতারবন্দি নয়, মানুষ কেবল পুরুষ। এ কথা অত্যন্ত কদর্য শোনালেও এর ভেতর সত্য আছে, আমরা অস্বীকার করতে পারব না। যেহেতু নারীর কোথাও আশ্রয় নেই, সেহেতু তাকে ঠোক্কর খেতে হয় সর্বত্র। পরিবার নারীকে বাঁধে উপার্জনহীনতার দোহাই দিয়ে। ধরেই নেয় যে একটি ছেলে একটি মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করবে, তাই মেয়েটির অধিকার সীমিত হওয়া প্রয়োজন। অনেকেই বলবেন, এই ধারণা বদলাচ্ছে, স্বীকারও করছি তা, কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে তা প্রমাণ করে না। সমাজ এখনো শাসিত পুরুষের দ্বারা। শাসক হিসেবে একচ্ছত্র যাদের ক্ষমতা, তারা সেই ক্ষমতাকে সুষ্ঠুভাবে, নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করবে_এমন নজির নেই কোথাও, এমনকি প্রকৃতিতেও নেই। ক্ষমতাশালী দুর্বলকে (নারী দুর্বল নয়) গ্রাস করে তাই-ই চিরায়ত সত্য। পুরুষের এই শাসনে সমাজে তৈরি হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। এই ভারসাম্যহীনতার সুযোগে সমাজের নারীটি প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে এবং পদদলিত হচ্ছে নারীটির অধিকারও।
যেহেতু সমাজই নির্ধারণ করে দেয় সম্পর্ককে, সেহেতু, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে নর-নারীর সম্পর্ককে সমাজ দ্বারা সিদ্ধ করে নিতে হয় এবং সে ক্ষেত্রে নারী আসলে 'বস্তুমাত্র', যা পুরুষের ভোগ্য ও প্রয়োজনে ব্যবহৃত। আবারও বলছি, ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটছে, কিন্তু তা বাস্তবতা থেকে বহু দূরে অবস্থান করে কেবল। সমাজ ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক বিচারে বিশেষজ্ঞরা এ কথা বারবারই বলেছেন, সমাজ যা চায়, ধর্ম আসলে তাই-ই বলে। যেহেতু ধর্মগ্রন্থসমূহ বেশির ভাগই পুরুষ রচয়িতার হাত দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু নারীকে বেশির ভাগ ধর্মগ্রন্থই একেবারে নিম্ন কাতারে নিয়ে বসিয়েছে। যেখানে বসে কেবল উঁচু স্তরের সেবা করতে হয়। ধর্ম এখানে নারীকে ঠিক ততটুকুই দিতে চায় বা দিয়ে থাকে, যা দিয়ে নারীকে বংশবৃদ্ধিতে অংশ নেওয়ানো যায়, নারীর কাছ থেকে সেবাটুকু আদায় করা যায়। যখনই নারী এর বাইরের কিছু দাবি করে তখনই নারীকে কখনো ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে কিংবা দুশ্চরিত্রা বা ভ্রষ্টা বলে সমাজ তাকে কলঙ্ক দিয়ে সেই কলঙ্কমুক্তি ঘটানোর চেষ্টা করে। আমরা যতই আধুনিক বলে নিজেদের দাবি করি না কেন, এই সত্য থেকে এখনো মুক্ত হতে পারিনি।
কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা তো দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। রাষ্ট্রকে, বিশেষ করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থায় সরকারকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পরে মানুষের সামনে যেতে হয় ভোটের জন্য এবং সৌভাগ্যজনকভাবে নারী ভোটাধিকার অর্জন করেছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে; সেহেতু রাষ্ট্রকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে হয়, যার কিছুটা পশ্চিমারা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মতো পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থায় এখনো তা অর্জিত হয়নি বলে নারী রাষ্ট্রের নিম্ন শ্রেণীর নাগরিক এবং তার অধিকার সীমিত। পরিবার বা সমাজ যতটুকু দেয় ততটুকুই, রাষ্ট্র যেন এর বেশি কিছুই করতে পারে না। কিছু আইন আছে ঠিকই, কিন্তু তার প্রয়োগ যার হাত দিয়ে ঘটবে তাদের মধ্যে পুরুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে নারী উপেক্ষিত, নির্যাতিত ও নিগৃহীত। আর এ কারণেই হাসান সাঈদের ভেতরকার পশুত্ব রুমানা মনজুরকে নগ্নভাবে আহত করে এবং আমরা তাই-ই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কিংবা তার প্রতিবাদও করি। কিন্তু তাতে সামগ্রিক চিত্র কি বদল হয় কিছুটা? রুমানা মনজুর সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, তিনি ক্রমেই শিরোনাম থেকে নেমে ভেতরের পাতায় যাবেন এবং তারপর হারাবেন। আর নারী অধিকার নিয়ে সরকারের নীতিমালার বিরুদ্ধে আমিনী-বাহিনী রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করবে। পরিস্থিতি যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে, এর চেয়ে একচুলও এগোবে না_এই কি সত্য নয়?
পুনশ্চ : সৌদি আরবে এক নারী সম্প্রতি গাড়ি চালাতে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে একটি জরিমানামূলক টিকিট পেয়েছেন অনির্ধারিত জায়গায় পার্কিংয়ের জন্য। তিনি হাসতে হাসতে এই জরিমানা মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যাক শেষ পর্যন্ত সৌদি পুলিশ একজন নারীকে গাড়িচালক হিসেবে মেনে তো নিয়েছে, এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া, জরিমানা তো আসলে নস্যি!
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ, editor@ekpokkho.com

No comments

Powered by Blogger.