পশ্চিমাঞ্চলীয় রেলওয়ের দুরবস্থা by মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

কবি শামসুর রাহমান রেলগাড়িকে কেন্দ্র করে শিশুদের জন্য ছড়া লিখেছেন : 'ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে/রাত দুপুরে অই/ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে/ট্রেনের বাড়ী কই?' রেলগাড়ির প্রতি ভালোবাসা থেকে সম্ভবত শামসুর রাহমানের এই ছড়াটির উদ্ভব। এমনকি শিশু-কিশোর, প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সবারই ট্রেনের ছন্দময় শব্দ ভালো লাগে।


বাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কেউ ছড়া লিখেছেন কি না চোখে পড়েনি। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে 'জার্নি বাই বাস' রচনা পড়েছিলাম। এতে বাস ভ্রমণ কতটুকু আনন্দদায়ক ছিল সে বর্ণনা মনে নেই। তবে বাস ভ্রমণে আকৃষ্ট এমন মানুষের শতকরা হার যথেষ্ট বলে মনে হয় না। তার পরও ট্রেনের কেন প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয় না, তা বোধগম্য নয়। তবে মাঠ পর্যায়ে যেসব কর্মচারী সরাসরি যাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত তারা বেশির ভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত- এটা ভুক্তভোগী প্রায় সবাই স্বীকার করবেন। বর্তমান আলোচক খুলনা থেকে রাজশাহী বা রাজশাহী থেকে খুলনায় প্রায় সাপ্তাহিক যাত্রী। কর্মস্থলে কোনো পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি না থাকলে বৃহস্পতিবার রাজশাহী গেলে শনিবারে খুলনা আসা হয়। খুলনা ট্রেন স্টেশনটির একেবারে জীর্ণদশা। সম্ভবত কোনো বিভাগীয় সদরে এত অবহেলিত ও জীর্ণ স্টেশন আর নেই। প্লাটফরম থেকে ওপরে উঠতে ও নিচে নামতে অনেক যাত্রীরই অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। গ্রাউন্ড লেবেল থেকে ট্রেন এতই উঁচু যে কোনো অসুস্থ মানুষের পক্ষে একা ওপরে ওঠা কল্পনাই করা যায় না। একদিন দেখা গেল, একজন সন্তানসম্ভবা ভদ্রমহিলাকে তাঁর স্বজনরা একটা ভাঙা চেয়ারের ওপর উঠিয়ে তারপর ট্রেনে তুলছেন। এ দৃশ্য সেদিন অনেককে ব্যথিত করেছিল। বছরখানেক আগে শোনা গিয়েছিল যে খুলনা রেলস্টেশন পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি, অর্থ কাগজে-কলমে বরাদ্দ করা হলেও সরকারের কোষাগারে টাকা নেই। এটি মানুষকে ভীষণ হতাশ করছে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই অতীতে দক্ষিণবঙ্গের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। এবার মানুষ হতাশ হওয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তুত নয়।
বৃহস্পতিবার রাজশাহী যেতে হলে সোম বা মঙ্গলবারে টিকিট করতে পাঠাই। গত ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গমন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে ২৩ তারিখে রাজশাহী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এ জন্য ২১ তারিখে একজন কর্মচারীকে টিকিট করতে ট্রেন স্টেশনে পাঠাই। সংশ্লিষ্ট কর্মচারী আমাকে ফোনে জানান, প্রথম শ্রেণীর কোনো আসন খালি নেই। পরে শোভন শ্রেণীতে টিকিট করে নির্ধারিত দিনে স্টেশনে পৌঁছাই। ওই দিন ট্রেন ছাড়ার পর দেখা গেল, প্রথম শ্রেণীর অনেক আসন ফাঁকা। পরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে আসন মিলল। এর পর ৩০ নভেম্বরের টিকিট করতে ২৭ নভেম্বর পাঠাই। ওই দিনও একই বক্তব্য 'প্রথম শ্রেণীর আসন খালি নেই'। নির্ধারিত দিনে যথারীতি ট্রেনে উঠে দেখা গেল, প্রথম শ্রেণীর অনেক আসন খালি পড়ে রয়েছে। ট্রেনের কর্মচারীদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান, যশোর থেকে জিএম সাহেব উঠবেন, সে জন্য আসনগুলো ফাঁকা রাখা হয়েছে। ২৪টি প্রথম শ্রেণীর আসনের মধ্যে একজন কর্মকর্তার জন্য কেন ১৬টি আসন ফাঁকা রাখা হলো জিজ্ঞেস করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। ডিসেম্বর ১৯১১ সালের ৮ তারিখে এবং জানুয়ারি ১৯১২-র ৫ তারিখে একই ঘটনা ঘটল। ওই দিন বিষয়টি পশ্চিমাঞ্চলীয় জিএম সাহেবের নজরে আনা হয়। এমনকি রেলমন্ত্রীকেও বিষয়টি অবহিত করার ব্যবস্থা করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এর পরও একই ঘটনা ঘটেছে। জিএম সাহেব অবশ্য জানিয়েছেন যে তাঁর ওই সময়ে যশোরে কোনো কর্মসূচি ছিল না। ধরে নেই, জিএম সাহেব ওই দিন গিয়েছিলেন কিন্তু তার জন্য ১৬টি আসন প্রয়োজন ছিল কি না- এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? প্রায়ই দেখা যায়, ট্রেনের স্টাফ বা তাঁদের আত্মীয়স্বজন পাস অথবা টিকিট ছাড়া প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করেন। এতে অনেক যাত্রীরই প্রথম শ্রেণীতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাঁরা যেতে পারেন না। ইচ্ছা করেই হয়তো স্টাফ বা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের জন্য আসনগুলো ফাঁকা রাখা হয়। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে টিকিট ক্রয়েচ্ছু মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। গত ২ ফেব্রুয়ারি ট্রেনে উঠে জানা গেল যে খুলনা স্টেশনের ম্যানেজার রাজশাহী যাচ্ছেন। ঈশ্বরদী ছেড়ে যাওয়ার পর একজন সহযাত্রী বললেন, ট্রেন হরিয়ান থামতে পারে। এখানে উল্লেখ্য, রাজশাহী স্টেশনের আগেই হরিয়ান। এটি সাগরদাঁড়ি বা কপোতাক্ষের জন্য নির্ধারিত স্টেশন নয়। তথাপি রাত ৯টা ৪০ মিনিটে এখানে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন পাশের যাত্রীদের ভীষণ বিরক্ত হতে দেখেছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হরিয়ানের স্টেশন মাস্টার স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজশাহী থেকে সৈয়দপুর-পার্বতীপুর লাইনে বরেন্দ্র ও তীতুমীর এঙ্প্রেস যাতায়াত করে। এ দুটি ট্রেন চোরাকারবারিদের স্বর্গ- এটি সবাই জানে। সবার চোখের সামনে রেলওয়ে পুলিশ চোরাকারবারিদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ টাকা আদায় করে। কারণ তারা টিকিট করে ট্রেনে ওঠে না। ট্রেনের টিটিইরা তাদের কাছ থেকে দু-চার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেন। কথা বললে উত্তর মেলে 'চোরাকারবারিরা খুবই শক্তিশালী।' আমরা জানি না, রাষ্ট্রের চেয়ে কেউ বেশি শক্তিশালী হতে পারে কি না? খুলনা-রাজশাহী ট্রেনে কোনো এসি বগি নেই। সিটগুলো এতই প্রশস্ত যে আরামে বসে যাওয়া যায় না। ভেতরে ফ্যান চললেও কোনো বাতাস লাগে না। প্রায় ৩০ বছর আগে আনা পুরনো বগি দিয়ে এই ট্রেন চলছে। তার পরও 'নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো' মনে করে আমরা এতে যাতায়াত করি। কিন্তু এত অনিয়ম একদিকে যাত্রীদের ভীষণ আহত ও ক্ষুব্ধ করে, অন্যদিকে সরকার লোকসান গুনে। রাজশাহী থেকে রহনপুর লাইনের একজন গার্ড এখন রাজশাহী-ঢাকা ও খুলনা-রাজশাহী ট্রেনেও গার্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন। একদিন ঢাকা যাওয়ার পথে কাউন্টারে এসি প্রথম শ্রেণীর টিকিট না পেয়ে শোভন শ্রেণীর টিকিট করি। পরে দেখা গেল এসি প্রথম শ্রেণীতে দুটি সিট ফাঁকা আছে। পরে ওই ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম, আমার টিকিটটি এসিতে কনভার্ট করার জন্য। তিনি আমাকে ওই সিটে (এসিতে) বসতে বললেন। পরে নতুন টিকিট দেওয়ার কথা বললে তিনি টিকিট না দিয়ে ১০০ টাকা চাইলেন। আমি বেশি টাকা দিয়ে টিকিট পেতে চাই বলায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। ইদানীংও ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। মানুষ রেল ভ্রমণে বেশি আগ্রহী, তার পরও রেলে কেন এত লোকসান হয়- তা সরকারের অনুধাবন করা প্রয়োজন। যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি ভাড়া বাড়ালেও ট্রেনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়বে বৈ, কমবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। দুর্নীতি রোধ করতে পারলে ট্রেন অবশ্যই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। ট্রেনের প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অনেক বেশি। সাম্প্রতিককালে একটা বিষয় চোখে পড়ছে যে ট্রেন কিছুটা সময় মেনে চলার চেষ্টা করছে। পুরনো ইঞ্জিন ও সিঙ্গেল লাইনের কারণে এই প্রচেষ্টা ইচ্ছা থাকলেও সব সময় পূরণ হয় না। বর্তমান রেলমন্ত্রীর কাছেও মানুষের প্রত্যাশা ব্যাপক। জানি না, এ আশা কতটুকু পূরণ হবে।

লেখক : উপ-উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.