এসো নীপবনে-আহত কাকছানা by আবুল হায়াত

প্রকল্প এলাকার মধ্যেই অনেক খামারবাড়ি। কৃষকেরা পরিবার নিয়ে বসবাস ও চাষাবাদ করেন। তাঁদের চাষাবাদের সাহায্যের জন্যই আমাদের প্রকল্প। প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে, তাই কাজ চলছে রাত-দিন। এই ব্যস্ততার মাঝে সেদিন পানির পিপাসায় বড়ই কাতর আমি। কাছের কৃষক ভাইয়ের বাড়ির দিকে রওনা হলাম, এক গ্লাস পানির জন্য।


হঠাৎই খেয়াল করি বাড়ির ভেতর থেকে মালিক ছুটে আসছে চিৎকার করতে করতে। আমার চলার গতি কমে এল। হঠাৎ খেয়াল করি সে বলছে, বন্দুক, বন্দুক।
আর সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল একটি কিশোর বাড়ির ভেতর থেকে বন্দুক নিয়ে দৌড়ে আসছে তার দিকে।
এবার আর গত্যন্তর নেই। দাঁড়ালাম। হাত দুটো ওপরের দিকে এমনিই উঠে গেছে ততক্ষণে। আমার পেছনেও চিৎকার শুনে ঘুরে দেখি, আমার লিবিয়ান রাজমিস্ত্রি মাবরুক ছুটে আসছে আমার দিকে। পরিস্থিতি অতিগুরুতর! চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাবরুক আর বাড়ির মালিকের মধ্যে অনেক কথাবার্তার পর খাতির করে আমাকে কৃষক মহোদয় পানি পান করালেন। বুঝতেই পারছেন, লিবিয়ায় চাকরির সময়কার ঘটনা।
পরে জানলাম, সে ভেবেছে আমি তার স্ত্রীর প্রতি নজর দেওয়ার জন্য তার বাড়ির কাছে যাচ্ছিলাম এবং স্বভাবসুলভ কারণে বন্দুক বের করেছে সে। আরবি ভাষায়ও বন্দুককে বন্দুক বলা হয়। এটা তাদের শখের একটা অস্ত্র, ব্যবহারটাও করে খেয়ালখুশিমতো।
মায়ের কাছ থেকে যেমন চায়ের নেশা পেয়েছিলাম, তেমনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম শিকার করার নেশা। আমার বাবা মরহুম আবদুস সালামের বহু রকম শখ এবং গুণের মধ্যে পাখি শিকার ছিল অন্যতম প্রধান। সেই পঞ্চাশের দশকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ধার করে পাঁচ শ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন আমেরিকান উইনচেস্টার কোম্পানির সিঙ্গেল ব্যারেল সিক্স শট রিপিটার বন্দুক। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবাকে পাখি আর হরিণ শিকার করতে দেখতাম। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতাম ওই সব শিকার দেখে। মনে মনে লালন করতাম ইচ্ছা, নিজেও বাবার মতো একজন শিকারি হব। বাবা নিজের হাতে আমাকে বন্দুক ধরিয়ে দিয়েছিলেন ঘুঘু মারার জন্য। প্রথম শটে দুটোর মধ্যে একটিকে মারতে পেরেছিলাম (আজ খুব মন খারাপ করে সেই সব পাখি হত্যার কথা মনে হলে)। তারপর প্রায়ই বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম শিকার করতে। রীতিমতো নেশাগ্রস্তের মতো। আমেরিকাকে দেখলেই বোঝা যায়, কী কঠিন নেশা আগ্নেয়াস্ত্র। ধ্বংসের নেশা এতে। হাতে থাকলে মনে হয় ধ্বংস করো—যখন-তখন, যাকে-তাকে।
আগ্নেয়াস্ত্রের জন্ম-ইতিহাস কিন্তু অদ্ভুত। চীনে ট্যাং রাজত্বকালে ৮৫০ সালের দিকে এক উদ্যমী রসায়নবিদ মানুষকে অমর করার জন্য এক সাহসী পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। বহুবার ব্যর্থ হওয়ার পর চূড়ান্ত স্তরে এক সংমিশ্রণ তৈরি করেন, যাতে ৭৫ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেটের সঙ্গে ১০ শতাংশ সালফার এবং ১৫ শতাংশ চারকোল মেশান। এটি আগুনের সংস্পর্শে আসামাত্র বিস্ফোরিত হয় ভীষণভাবে। আলকেমির দুই হাত পুড়ে, মুখ পুড়ে—ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
যা হোক, এর থেকে কিন্তু চীনারা অমর হওয়ার ওষুধ না পেলেও আতশবাজি ফোটাতে পেরেছিল। তবে অস্ত্র হিসেবেও চীনারাই প্রথম ব্যবহার করে এই রসায়ন, যার নাম গানপাউডার, মোঙ্গলদের আক্রমণ ঠেকাতে। নিজেরা বন্দুক তৈরি করেছিল বাঁশ কেটে নল বানিয়ে—এটাই হলো পৃথিবীর আদিম বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র। এই গানপাউডার ১৩ শতকে ইউরোপে যায়। সেখানে এটাকে উন্নত করা হয়। ১২৪৭ সালে যুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়।
আমার কথা বলি। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় মাটির ব্যাংকে পয়সা জমিয়ে একটা এয়ারগান কিনেছিলাম। ৪১ টাকা দাম পড়েছিল। বন্দুকটা হাতে পেয়ে আমার ছটফটানি দেখে কে! গুলি করে কিছু শিকার না করা পর্যন্ত শান্তি হারাম। বাসার উঠানে ছিল এক আমগাছ। তাতে কাকের বাসা। তার উপদ্রবে মা অস্থির থাকতেন সব সময়। বললেন, বাপ, একটা কাক মেরে দে। ওদের জ্বালাতন তো আর সয় না।
আমি লেগে গেলাম কাক মারতে। অসম্ভব। কাক আমার চেয়ে হাজার গুণ চালাক। দিন সাতেক চেষ্টায় একটাকেও গুলি লাগাতে পারলাম না। অষ্টম দিনে ঘটনা ঘটল, একটা বাচ্চা-কাক বাসা থেকে উড়ে এসে বসল আমাদের উঠানের তারে।
আমার হাত তো নিশপিশ করছিল। খুব কাছে থেকে তাক করে ছুড়লাম গুলি। লাগল পায়ে। আর উড়তে পারে না। আমি বিজয়ী বেশে সেটাকে ধরে বন্দী করলাম। শুরু হলো কাকদের চিৎকার-চেঁচামেচি। একসময় তা থামল বটে। তবে দুই দিন পর ঘটল আসল ঘটনাটা।
স্কুলে যাচ্ছিলাম সকালে। হঠাৎ মাথার ওপর একঝাঁক কাকের চিৎকার-চেঁচামেচি। তারা আমার পিছু নিয়েছে। আমি ভয়ে ঘরের দিকে দৌড়ালাম। এর মধ্যে এক বদমাশ সন্ত্রাসী কাক দিল মাথায় ঠোকর। বেরোল রক্ত। আমি আহত।
আজ বারবার মনে হচ্ছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কাকও জানে। এই কাকদের কথা খুব মনে পড়ে আমার, যখনই পত্রিকায় কোনো খবর পড়ি লিমনের। লিমন যেন সেই আহত কাকছানা!
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.