বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-নেভার আগে প্রদীপের জ্বলে ওঠা by মাসুম আলী

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির শেষ শনিবার। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল। শেষবারের মতো ছুটির দিনের স্বাদ পেল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রকাশকেরা বলেন, মেলার শেষ সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে এ রকমই হয়। তাঁরা মানুষের বাঁধভাঙা এ ভিড়কে নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের জ্বলে ওঠার সঙ্গে তুলনা করেন।


অবশ্য একই সঙ্গে আসন্ন বিদায়ের বিষাদের ছোঁয়া ছিল তাঁদের কণ্ঠে। বিশেষ করে, তরুণ লেখকদের মধ্যে বিষাদের ছোঁয়া ছিল বেশি। এখন যাঁরা মেলায় আসছেন, তাঁরা প্রায় সবাই দু-একটি বই কিনে ফিরছেন। ফলে বিক্রিও বেড়েছে। আগামী প্রকাশনীর ওসমান গণি বললেন, ‘এবার মেলায় অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি বেশ ভালো। প্রথম সপ্তাহ থেকে পর্যায়ক্রমে বিক্রি বেড়েছে। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে।’ বাংলা একাডেমী সূত্রও বলছে তাই, এবার তুলনামূলকভাবে বিক্রি বেড়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় এমন ভিড় ছিল যে মেলায় ঢুকতে প্রায় শাহবাগ পর্যন্ত লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সংগীত পরিচালক ইজাজ খান জানান, প্রতিবছর বইমেলার শেষ দিকে আসেন তিনি। তবে এবার আর আগের মতো স্বস্তি বোধ করছেন না। কেননা, মেলার মূল চত্বরে গাদাগাদি করে স্টল তৈরি করা হয়েছে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরেফিরে পছন্দ করে বই কিনে স্বস্তি পাওয়া যায় না।
মেলার সংবাদ সংগ্রহে আসা গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেও ছিল বিষণ্নতা। একাডেমীর জনসংযোগ কর্মকর্তার কক্ষের সামনে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তরুণ সংবাদকর্মী আসিফুর রহমান, মোরসালিন মিজান, এস এম মুন্না, দীপন নন্দী, ফরহানা তিথি ও অন্যরা। আর কয়েক দিন পরই তো এভাবে একসঙ্গে লেখালেখি হবে না, মিলবে না আড্ডা দেওয়ার সুযোগ!
টাস্কফোর্সের অভিযান
গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো মেলায় অভিযানে নামে টাস্কফোর্স। প্রাঙ্গণের ভেতরের স্টলগুলোতে পাইরেটেড বইসহ নীতিমালাবহির্ভূত বইয়ের বিরুদ্ধে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে নয়টি স্টলকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। আজ রোববার স্টলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন একাডেমীর পরিচালক শামসুজ্জামান খান। বিকেল চারটা থেকে এক ঘণ্টার এ অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার মনজুরুর রহমান, একাডেমীর সচিব আলতাফ হোসেন, মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব শাহিদা খাতুন, প্রকাশক ফরিদ আহমেদ প্রমুখ। এ অভিযানে নয়টি স্টল থেকে ডোরেমন, পোকেমন, মি. বিন, এনসাইক্লোপিডিয়া, বারবি ডলসহ অননুমোদিত বই জব্দ করা হয়। তবে একাডেমী কর্তৃপক্ষ সতর্ক করা স্টল বা বইয়ের তালিকা এখনো প্রকাশ করেনি। কপিরাইট রেজিস্ট্রার মনজুরুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, অভিযানে প্রায় ১২৫টি বই জব্দ করা হয়েছে। আর সতর্ক করা স্টলগুলোর মধ্যে রয়েছে: দি ইউনিভার্সেল একাডেমী, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, সাহিত্যমালা, সালমা বুক ডিপো, কল্পদূত, অন্তরীপ পাবলিকেশন্স, লাবণী পাবলিকেশন্স, শৈলী প্রকাশন ও বাংলা প্রকাশ। যেসব প্রকাশনা সংস্থা কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে বই প্রকাশ করেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কপিরাইট আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে মেলার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আজ রোববার বিকেলে আগামী মেলার কর্মপরিকল্পনা এবং এ অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে একাডেমী।
মেলার নতুন বই: কবীর চৌধুরীর আমার ছোটবেলা মেলায় এনেছে অ্যাডর্ন; শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা এনেছে হাক্কানী পাবলিশার্স; অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে এনেছে প্রথমা প্রকাশন; আলী যাকেরের সেই অরুণোদয় থেকে এনেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ; প্রকৃতি থেকে এসেছে কুমার চক্রবর্তী অনূদিত টমাস ট্রান্সট্রোমারের আত্মজীবনী স্মৃতির চাহনি, নাবিব সালেহর প্রবন্ধ সমাজ সাহিত্য ও সংস্কৃতি: দর্শন ভাবনা, বিনয় বর্মনের কাব্য বিনিময়ে তুমি তাকে কতটুকু দাও; শরীফ খানের সেরা শিশু-কিশোর গল্প এনেছে ঝিঙেফুল; সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অলস দিনের হাওয়া এসেছে শুদ্ধস্বর থেকে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আরও এসেছে ইকবাল হোসাইন চৌধুরীর প্রেম এসে যাচ্ছে ও অন্যান্য। আলম তালুকদারের যখন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম মেলায় এনেছে দিব্যপ্রকাশ; বারো মাসে তেরো ছড়া এনেছে বলাকা; বহ্নিশিখা জামালীর নারী-প্রকৃতি প্রাণবৈচিত্র্য ও আমাদের বিপন্ন অস্তিত্ব এনেছে তরফদার প্রকাশনী; শিখা প্রকাশনী থেকে এসেছে শাহাদাত সোহাগের রহস্যপুর ও রানা।
মেলা মঞ্চে গতকাল কবি শারমিন সুলতানার কাব্যগ্রন্থ মা এক পৃথিবীর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে।
সেই সব দিনগুলো
শনিবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে আয়োজিত ‘বাংলার মনীষা: মোহাম্মদ কিবরিয়া’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নজরুল ইসলাম। আলোচনা করেন হাশেম খান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মিজারুল কায়েস ও শরীফ আতিক-উজ-জামান। সভাপতিত্ব করেন হাসনাত আবদুল হাই। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাটক সেইসব দিনগুলো মঞ্চস্থ করে নাগরিক নাট্যাঙ্গন।

No comments

Powered by Blogger.