চারদিক-রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে by মোছাব্বের হোসেন

আমাদের দেশে ওদের বেড়ে ওঠাটা তেমন সহজ নয়। নানা ধরনের বাধাবিপত্তি পাড়ি দিতে হয় ওদের। সুবিধার কথা বলছেন? তা তো ওদের জীবনের জন্য মরীচিকার মতো! বলছি রোহিঙ্গা শিশুদের কথা। মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও বেড়ে ওঠে এ দেশের ভূখণ্ডে। তাদের আদিনিবাস মিয়ানমারে।


বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের কিছু অংশে মিয়ানমারের এই বাসিন্দারা বাস করছে। তাদের বলা হচ্ছে রোহিঙ্গা। তাদের উদ্বাস্তুও বলে থাকে কেউ কেউ। রোহিঙ্গা শিশুরা বেড়ে ওঠে একটা নির্দিষ্ট এলাকায়। চারদিক সম্পর্কে তেমন জানার সুযোগ পায় না এরা। একটা গণ্ডির মধ্যেই ঘুরপাক খায় ওদের জীবন। সমাজের অন্যরা যে তাদের দিকে অবহেলার চোখে তাকায়, এটা বুঝতে পারে এই শিশুরা। আর তাই তো চুপটি করে বসে থাকে। যে মুখে কথার খই ফোটার কথা, আনন্দে যাদের দাপাদাপি করার কথা, তাদের মুখেই রাজ্যের বিষণ্নতা।
খানিকটা অন্য প্রসঙ্গে যাই এবার। সারা দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন উলফাৎ কবীর। পেশায় তিনি একজন জাদুশিল্পী। জাদুবিদ্যাটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন। আর শিশুদের জাদু দেখিয়ে মজা পান তিনি। শিশুদের অকৃত্রিম হাসি তাঁর মনের খোরাক জোগায়। তিন বছর ধরে উলফাৎ দেশের বিভিন্ন স্থানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জাদু দেখান। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি দলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের প্রাথমিক স্কুলে যান। এ কাজটি করেন মনের আনন্দ থেকেই। বিনিময়ে কিছুই নেন না। শিশুদের তিনি জাদুর ছলেই নানা শিক্ষামূলক উপদেশ দেন। শিশুদের অনুভূতির কথা তাঁর মুখেই শোনা যাক, ‘আমি যখন জাদু দেখাই, শিশুরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তখন আমিও শিশু হয়ে যাই। শিশুদের ভালো লাগা আর ভালোবাসায় একাকার হয়ে যাই।’
‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে সচেতনতা কম। এ কারণে তাদের রোগবালাইও বেশি হয়। মা-বাবা অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হওয়ার ফলে শিশুদের ছোট ছোট রোগবালাই এড়িয়ে যান। সঠিক যত্ন নেন না। এর ফলে শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আর তাই জাদুর মধ্যেই শিশুদের সচেতন হওয়ার শিক্ষা দিই।’ বলেন উলফাৎ কবীর।
উলফাৎ কবীর জানান, খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, টয়লেটে খালি পায়ে না যাওয়া, সেখান থেকে এসে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করাসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ করেন। আর জাদুর মধ্য দিয়ে এসব সচেতনতার শিক্ষা দেওয়া হয় বলে শিশুরা খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে। বাড়িতে ফিরে এ কাজগুলোর অভ্যাস করে। অন্য শিশুদেরও তারা শেখায়।
গত ২০ জুন ছিল বিশ্ব শরণার্থী দিবস। এ দিনটিতে তিন বছর ধরে উলফাৎ কবীর রোহিঙ্গা শিশুদের পাশে যান। তাদের সঙ্গে সময় কাটান। এবারও তিনি গিয়েছিলেন টেকনাফের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং নামের একটি স্থানে। এখানকার একটি জায়গাজুড়ে বসবাস করে রোহিঙ্গারা। দুটি ক্যাম্প রয়েছে রোহিঙ্গাদের। তাদের অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গী হয়েছে শিশুরাও। বিভিন্ন স্থানে লেখা আছে ‘বুনো হাতি থেকে সাবধান’। প্রতি পদে পদে বিপদকে সঙ্গী করে এখানকার শিশুরা বড় হচ্ছে। ‘এসব দেখে এই শিশুদের জন্য মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায় আমার।’ বলছিলেন উলফাৎ কবীর। শিশুদের গায়ে ঠিকমতো কাপড় নেই, অনাহার-অবহেলায় এদের বেড়ে ওঠা দেখে অনেক কষ্ট লাগে তাঁর মনে। তার পরও এই শিশুদের খানিকটা আনন্দ দেবেন বলে মনে কিছুটা আনন্দ লাগিয়ে জাদু দেখানো শুরু করেন তিনি।
রঙিন একটা বেলুন ফুলিয়ে শিশুদের সামনে ধরে বলেন তিনি, ‘বলো তো এটা কী?’
কোনো কোনো শিশু দেখেই বলে দেয়, এটা বেলুন। আর কোনো কোনো শিশু আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে!
বেলুন ফোলানো হলে তিনি সবার সামনে সেটি তুলে ধরেন। খানিকক্ষণ বাদেই ফাটিয়ে দেন বেলুনটি। শিশুরা আশাভঙ্গ হওয়ার আগেই সেখান থেকে বের হয় জীবন্ত এক কবুতর। শান্তির কবুতর হাতে সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন উলফাৎ কবীর। শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বারবার হাতে তালি দেয়। মজা পেয়ে এর-ওর দিকে তাকায়। বেমালুম ভুলে যায় তাদের দুঃখকষ্ট মেশানো জীবনটাকে। কোনো কোনো শিশু সাহস করে সামনে এসে বলে, ‘এটা কি সত্যিই কবুতর!] তারা কেউ কেউ আবার মনের কৌতূহল মেটাতে হাতে ধরে দেখে কবুতরটি। একদম বিশ্বাস করতে চায় না নিজের চোখকে!
অনেক শিশু আবার এই জাদুবিদ্যা শেখার আগ্রহ দেখায়। কাছে এসে বলে, ‘আমাদের শেখাবেন জাদু? আমিও সবাইকে জাদু দেখিয়ে বেড়াব।’ উলফাৎ কবীর বলেন, ‘শিশুদের আগ্রহ আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায় তাদের নিয়ে।’ মনে মনে স্থির করেন, এই শিশুদের তিনি জাদু শেখাবেন। সামনের বছরই এই শিশুদের জাদু শেখাবেন আর জাদুর কিছু উপকরণও দেবেন। অকৃত্রিম ভালোবাসা ছাড়া বিনিময়ে আর কিছুই নেবেন না তিনি!
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.