সময়ের প্রেক্ষিত-আজুমা: বঙ্গপ্রেমী অনন্য এক বিদেশি by মনজুরুল হক

বাংলাদেশের প্রতি সত্যিকার অর্থে যাঁরা গভীর মমত্ব পোষণ করেন, সে রকম বিদেশির সংখ্যা বলা যায় একেবারেই হাতেগোনা। বিদেশিদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য বাংলাদেশকে ভালোবাসা কিংবা দেশটিকে হূদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারার কথা বলে থাকেন। তবে সে রকম বক্তব্য কতটা আন্তরিক এবং কতটা তা কেবল বলতে হয় বলে বলা,


সেই প্রশ্ন এখানে থেকেই যায়। কেননা, বছরের পর বছর ধরে কোনো রকম প্রাপ্তির ভাবনা-চিন্তা মাথায় না এনে আমাদের দেশকে যাঁরা ভালোবেসেছেন, তেমন বিদেশির খোঁজ যে খুব সহজে মেলে, তা তো নয়। সে রকম এক বিরল চরিত্রই ছিলেন জাপানের সদ্যপ্রয়াত রবীন্দ্র গবেষক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজুও আজুমা। অধ্যাপক আজুমার প্রথম ভালোবাসা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গুরুদেব সম্বোধন ছাড়া অন্য কোনোভাবে কবিকে উল্লেখ করা তাঁর মুখ থেকে কখনো শোনা যায়নি। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসার সেই সূত্র ধরেই বাংলাদেশকে তাঁর জানা এবং সময়ের বিবর্তনে দেশটির প্রতি অনেকটা একই রকম ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়া।
অধ্যাপক আজুমার জীবনের সূচনাপর্ব অবশ্য বাংলাকে সে রকম গভীর ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়নি। ছাত্রজীবনে বাংলা ভাষার সংস্পর্শে তিনি আসেননি এবং কবিগুরুও সেভাবে তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেননি। তিনি ছিলেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র, যেখানে তাঁর পাঠের মূল বিষয় ছিল জার্মানির দর্শন। গেগেল, কান্ট ও মার্কসের দেশ জার্মানি দর্শনশাস্ত্রে অনেকটা যেন মধ্যযুগ থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলে চলেছে। এ কারণেই দর্শনের ছাত্রদের কাছে জার্মানির দর্শনচর্চার ইতিহাস হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ফলে ধারণা করা যায়, অনেকটা যেন পূর্বনির্ধারিত ছকে বাঁধা পথ ধরেই ছাত্রজীবনে অধ্যাপক আজুমা অগ্রসর হচ্ছিলেন। তবে সেই চলার পথে দিকনির্দশনা বদলে নেওয়ার বার্তাটি তিনি পেয়েছিলেন দর্শনের আরও গভীরে আলোকপাত করার মধ্য দিয়েই। তুলনামূলক দর্শনের পাঠে ভারতীয় দর্শন নিয়ে একসময় কিছু বইপত্র তাঁকে ঘেঁটে দেখতে হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে তাঁর আসা। ঘটনাক্রমিক সেই সংশ্লিষ্টতা এরপর তাঁর জীবনকে কীভাবে বদলে দিয়েছিল, সে কথা এখন আর আমাদের অজানা নয়।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে আজুমা শিক্ষকতায় যোগ দেন এবং জাপানের নেতৃস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য ইয়োকোহামা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তবে সেই যে দর্শনের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে তাঁর আসা, সেটা কিন্তু পরে সব সময় তাঁকে প্রভাবিত করে গেছে এবং কবিকে আরও ভালোভাবে বুঝে ওঠার তাগিদে একসময় বাংলা ভাষা শিখে নিতেও তাঁকে তা উদ্বুদ্ধ করেছিল। মূল ভাষায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের পাঠোদ্ধার করতে পারা কবিগুরুর ভাবনা ও দর্শন আরও ভালোভাবে বুঝে উঠতে অধ্যাপক আজুমাকে সাহায্য করেছিল। একই সঙ্গে সেটা আবার পথের দিকনির্দেশনা বদলে নিতেও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ১৯৭০ সালে ইয়োকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জাপানি ভাষার শিক্ষক হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যোগ দেন। বলা যায়, তখন থেকেই অধ্যাপক আজুমা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তিনি অবলোকন করেন ভারতে অবস্থান করার সময়ে। ফলে কী ঘটছে মুক্তি আর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাওয়া দেশটিতে, সে সম্পর্কে ভালোভাবেই তিনি ছিলেন অবগত। আর তাই বঙ্গভাষীদের নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব তাঁকে আনন্দ দিয়েছিল এবং বাঙালির ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় এগিয়ে নেওয়ায় নতুন রাষ্ট্র যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তা তিনি সহজেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এর আরেকটি কারণ অবশ্য হচ্ছে অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই ও মুনীর চৌধুরীর মতো স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় কিছু বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ। তাঁরা দুজনই তাঁদের সংক্ষিপ্ত জাপান সফরের সময় অধ্যাপক আজুমার সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং অধ্যাপক হাই তাঁর সঙ্গে মিলে বাংলা ও জাপানি ভাষার বিশেষ কিছু দিক নিয়ে যৌথ একটি মনোগ্রাফও সেই সময় প্রস্তুত করেছিলেন। উভয়ের অকালমৃত্যু অধ্যাপক আজুমাকে গভীরভাবে শোকাহত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাপান সফর করার সময় অধ্যাপক আজুমা প্রায় স্বার্বক্ষণিকভাবেই তাঁর দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ এক সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের বেলায়ও অচিরেই যবনিকাপাত ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। অনেকটা প্রায় সেই সময় থেকেই জাপানে নতুন করে ১২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের উদ্যোগের সঙ্গে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন এবং রবীন্দ্র রচনাবলী সম্পাদনার দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। রবীন্দ্র রচনাবলীর শেষ খণ্ডে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রচর্চা-সংক্রান্ত দুটি ভিন্ন রচনা সংযুক্ত করা আছে, যেগুলো লিখেছেন দুই অঞ্চলের দুজন প্রথিতযশা গবেষক। বাংলাদেশ পর্বের লেখক হচ্ছেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, যে যোগসূত্র গড়ে নেওয়ায় সামান্য কিছু অবদান আমি রাখতে পেরেছিলাম।
অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঠিক ৩২ বছর আগে, ১৯৭৯ সালের গ্রীষ্মে, অনেকটা যেন ঘুরপথ ধরে। সেবারই প্রথম আমার জাপানে আসা মস্কো থেকে বিমান, রেল ও জাহাজে দীর্ঘ পথ পার হয়ে। জাপানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কয়েক দিন আগে মস্কো ভ্রমণে আগত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক বিকেলে আমার খোঁজ করেছিলেন। সুভাষ দার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭২ সালের মার্চে তিনি যখন ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন, সেই তখন থেকে। কালি ও কলম-এর সম্পাদক, আমাদের শ্রদ্ধেয় হাসনাত ভাই তখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ঢাকা শহরে সুভাষ দার গাইড হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব তিনি আমার ওপর দিয়েছিলেন। সুভাষ দার সঙ্গে সেবার কাটানো কয়েকটি দিন বয়সের বিরাট ফারাক থেকে যাওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকটা যেন স্থায়ী এক সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিল। ফলে মস্কো সফরে এলে আমার খোঁজ তিনি প্রায়ই করতেন। টোকিও রওনা হওয়ার আগে সুভাষ দার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি যে জাপানে যাচ্ছি, সে কথা তাঁকে তখন আমি বলেছিলাম। আমার জাপান ভ্রমণের কথা শুনে তাৎ ক্ষণিকভাবে তিনি তাঁর জাপানি কবি বন্ধু কেন আরিমিৎ সুকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি লেখেন এবং চিঠিটি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, জাপানে যারা বাংলার চর্চা করছে, তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে সেই চিঠি আমাকে সাহায্য করবে।
জাপানে এসে কেন আরিমিৎ সুর ঠিকানায় আমি যোগাযোগ করি এবং সেদিনের সেই তরুণ জাপানি কবি এরপর আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে রকম পরিচয়ের সূত্র ধরেই একদিন উপস্থিত হয়েছিলাম অধ্যাপক আজুমার বাসভবনে। সেদিনের দীর্ঘ আলাপচারিতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল এবং এরপর আরও কয়েক দফায় তাঁর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ সেবার আমার হয়। পরের গ্রীষ্মে আবারও জাপানে আসার সময় আমার স্ত্রীর বাবা-মা অধ্যাপক আজুমার শরণাপন্ন হয়ে তাঁদের কন্যার বিয়েতে ম্যাচ মেকার হওয়ার দায়িত্ব পালনের অনুরোধ তাঁকে করায় সানন্দে তিনি তাতে সাড়া দিয়েছিলেন। তখন থেকে অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমার ঘনিষ্ঠতা। ফলে জাপানে রবীন্দ্র রচনাবলীর শেষ খণ্ডে বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা বিষয়ে কাকে দিয়ে লেখালে ভালো হবে, সেই পরামর্শ অধ্যাপক আজুমা আমার সঙ্গে করেছিলেন এবং সেই সূত্রে অধ্যাপক হায়াৎ মামুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা।
আশির দশকের প্রায় পুরো সময় ধরে আমাদের বাংলাদেশে অবস্থানকালে অধ্যাপক আজুমা ও তাঁর স্ত্রী একাধিকবার বাংলাদেশ সফরে এলে প্রতিবারই আমাদের বাসভবনে তাঁদের পদার্পণ ঘটেছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডন হয়ে আমাদের জাপানে চলে আসার পেছনেও আজুমা দম্পতি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। শেষবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় বছর চারেক আগে প্রধানমন্ত্রীর চেরি ফুল দর্শনের পার্টিতে। সেবারই তিনি জাপান সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন সম্রাটের বিশেষ পদক। তবে তত দিনে তাঁর স্বাস্থ্যের যে যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে, তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আমাকে অবশ্য তিনি বলেছিলেন যে এতটাই তিনি বাঙালি হয়ে গেছেন, এমনকি যে অসুখে তিনি আক্রান্ত, সেটাও হচ্ছে বাঙালি সচরাচর যে রোগে ভুগে থাকে, সেই ডায়াবেটিস। তিনি যে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলার প্রত্যন্ত এক জায়গায় বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছেন, সেই খবর আমি এর আগেই পেয়েছিলাম। তবে কারা এর সঙ্গে জড়িত, সে সম্পর্কে কখনো কোনো আগ্রহ আমি দেখাইনি। যেহেতু অধ্যাপক আজুমা নিজে থেকে এ বিষয়ে কখনো আমাকে কোনো কিছু বলেননি, তাই আমি ধরে নিয়েছিলাম, যাঁদের ওপর দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় তাঁর খুবই আস্থাভাজন, যদিও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি করার জন্য সংগৃহীত অর্থে বাংলাদেশে কারও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য লম্ফঝম্ফ চালানো এবং কেন্দ্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে চলার তৎ পরতা থেকে অনেকের মনেই ওই প্রকল্প নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তবে তার পরও কেন্দ্রটি গড়ে উঠুক, সে রকম প্রত্যাশা আমি করেছিলাম। শেষ দেখায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজ যে এগিয়ে চলেছে, সে কথা আমাকে জানাতে অধ্যাপক আজুমা ভোলেননি।
সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নিয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিকতা যে অধ্যাপক আজুমার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে, তাতে কোনো সন্দেহ একেবারেই নেই। ফলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার পরিপূর্ণ প্রকাশ দেখাতে হলে বাংলাদেশের যা করা দরকার, তা হলো আত্মসাৎ হওয়া অর্থের পুরোটা উদ্ধার করে বাংলাদেশের রাজধানীতেই সরকারের সংশ্লিষ্টতায় একটি জাপান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা, যে কেন্দ্রের নাম হতে পারে কাজুও আজুমা মৈত্রী কেন্দ্র। মৈত্রীর বন্ধন যে একেবারেই নিঃস্বার্থ হতে হয়, সেই শিক্ষাই তো আজীবন তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন, এমনকি নিজে প্রতারিত হওয়া সত্ত্বেও।
টোকিও
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.