কূটনীতি-হিনার ‘দিল্লি জয়’ ও পাকিস্তানি শাসকদের সুমতি! by সোহরাব হাসান

পাকিস্তানের নবীন ও প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারের সাম্প্রতিক নয়াদিল্লি সফর মোটেই ‘এলাম, দেখলাম ও জয় করলাম’ ছিল না। যদিও ভারতীয় গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়েছে। কূটনীতি ছাড়িয়ে গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর জৌলুসপূর্ণ সাজসজ্জা ও দামি পোশাক-অলংকার নজর কেড়েছে। সাংবাদিকেরা পাকিস্তানে সুন্দরী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর প্রভাব কতটা পড়েছে, বলা কঠিন।


পাঞ্জাবের খার সামন্ত পরিবারের মেয়ে হিনা রব্বানি। পড়াশোনা করেছেন লাহোর ও আমেরিকার ম্যাসাচুসেট ইউনিভার্সিটিতে। তাঁর চাচা গোলাম মোস্তফা খার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সহযোগী ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। গোলাম মোস্তফা খারের ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি বিবৃত হয়েছে তাহমিনা দুররানির মাই ফিউডাল লর্ড বইয়ে।
হিনার রাজনীতিতে আগমন পারভেজ মোশাররফের মুসলিম লিগের (কায়েদে আজম) মাধ্যমে। ২০০২ সালে তিনি দক্ষিণ পাঞ্জাবের রক্ষণশীল এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, যেখানে মোল্লাদের ভয়ে পোস্টারে নিজের ছবিও ছাপেননি। ২০০৭ সালে সাবেক জেনারেলের দল ছেড়ে হিনা পাকিস্তান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বার সাংসদ নির্বাচিত হন। ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানে স্নাতক ৩৪ বছর বয়সী হিনা প্রথমে গিলানি সরকারে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ২০ জুলাই থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী।
এমন এক সময় হিনা রব্বানি খার নয়াদিল্লি সফর করেন, যখন পাকিস্তান ও ভারত ‘অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে তাকানোর’ চেষ্টা চালাচ্ছে। গত সাত মাসে মাসে সচিব পর্যায়ে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। গত মাসে দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে ‘আলোচনা অব্যাহত’ রাখার ঘোষণা এসেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুম্বাইয়ে আরেক দফা বোমা হামলার ঘটনা ঘটে; যার সঙ্গে পাকিস্তানের ব্যক্তিগোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করছে ভারতের গোয়েন্দারা। তবে এর মূল হোতা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন।
এ অবস্থায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি সফর নিয়ে সংশয় ছিল। তবে ওসামা-পরবর্তী পাকিস্তানের ‘নড়বড়ে রাজনীতির’ সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি। গত মে মাসে ইসলামাবাদের কাছে অ্যাবোটাবাদে আমেরিকান কমান্ড বাহিনীর হাতে নিহত হন আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন। দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, লাদেনের মৃত্যুতে পাকিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠীর মনোবল ভেঙে গেছে এবং ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সহজ হবে। কয়েক দিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ভারতের চেন্নাই সফরকালেও জঙ্গি দমনে ভারত ও পাকিস্তানের একযোগে কাজ করার তাগিদ দেন।
হিনা রব্বানি খার নয়াদিল্লিতে নেমেই যে বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হলো, ক্রিকেট কূটনীতি। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের ক্রিকেট খেলা শুরুর আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নবযাত্রার কথাও বলেছেন। দিল্লিতে অবস্থানকালে হিনা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করলেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিষয়টি আনেননি। তিনি বলেছেন, ‘গত দুই দশকে আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, নতুন প্রজন্ম ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন সম্পর্ক দেখবে বলে আশা করছি।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা তাঁর প্রতিপক্ষকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘আমাদের সম্পর্ক সঠিক পথেই এগোচ্ছে। অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধানে ব্যাপক, আন্তরিক ও টেকসই আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।’
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে যেসব বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে, তা মামুলি হলেও ভারত ও পাকিস্তানের বর্তমান টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত-বাণিজ্য সপ্তাহে দুই দিনের স্থলে চার দিন করা, দুই কাশ্মীরের বাসিন্দাদের মধ্যে যাতায়াত সহজতর করা। আগে তারা কেবল আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেত এবং সে জন্য তিন-চার মাস আগে আবেদন করতে হতো। এখন পর্যটনকেন্দ্র ও ধর্মীয় স্থানগুলো পরিদর্শনেও যেতে পারবে এবং ৪৫ দিন আগে আবেদন করলেই হবে।
পাকিস্তানের জন্য বিব্রতকর ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে বোমা হামলার ঘটনাও আলোচনায় স্থান পেয়েছে। পাকিস্তান বরাবরই এর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু কাসাব নামে যে বোমা হামলাকারী বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক আছেন, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক এবং জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার সদস্য। এই লস্কর-ই-তাইয়েবা গড়ে ওঠে পাকিস্তাানি গোয়েন্দা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায়। ২০০৮ সালের বোমা হামলার দায়ে আদালত কাসাবকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তিনি তাঁর প্রাণভিক্ষা চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ভারত এই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য আসামিকে ধরার ব্যাপারে পাকিস্তানের সহযোগিতা চেয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হয়নি। পাকিস্তান দেশটির আসল চালক প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নন, সেনাবাহিনী।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বরাবর ক্ষমতা দখলের কারণ হিসেবে সিভিলিয়ান সরকারগুলোর ব্যর্থতা ও ভারতপ্রীতির দোহাই দিয়ে থাকে। আবার ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যে তারই সম্পর্কোন্নয়নে নানা তৎ পরতা চালায়। ১৯৯৯ সালে পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ‘ভারতবিরোধী’ জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও ‘হিন্দুত্ববাদী’ প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি একাধিকবার সফর বিনিময় করেছেন। শান্তির বাসযাত্রায় শামিল হয়েছেন। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালায়। কিন্তু সবকিছু ভণ্ডুল করে দেয় মুম্বাইয়ের বোমা হামলা। গিলানির সরকার আন্তরিকভাবেই চায়, মনমোহন সিং পাকিস্তানে আসুন। দিল্লিতে হিনা গিলানির দাওয়াতপত্রও তাঁকে পৌঁছে দেন। এ ব্যাপারে মনমোহন সিং নিজে কিছু না বললেও পাকিস্তানি গণমাধ্যম ইতিমধ্যে প্রচার করে দিয়েছে, তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। মৌনতা সম্মতি না অসম্মতির লক্ষণ, তা ভবিষ্যতই বলবে।
হিনা রব্বানি খারের এই সফরে পাকিস্তানের অর্জন কী? ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের চেয়েও তাদের বড় সমস্যা হলো জঙ্গি হামলা; আগে যারা সীমান্তের ওপরে হানা দিত, এখন তারা সীমান্তের ভেতরেই নিজ দেশে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে চলেছে। এখন পাকিস্তানের সমস্যা আল-কায়েদা ও তালেবান অনুসারীদের আত্মঘাতী হামলা বন্ধ করা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছে, তার অবসান ঘটিয়ে দেশটির নড়বড়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখা। এ ব্যাপারে মার্কিন সহায়তা যে খুব একটা কাজে আসেনি বলেই পুবের প্রতিবেশীর প্রতি শান্তির আহ্বান। গত মে মাসে মার্কিন কমান্ড বাহিনীর হাতে আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের হত্যার ঘটনা সাধারণ পাকিস্তানিদের ক্ষুব্ধ করেছে। যে দেশের নৌ, সেনা বা বিমানবাহিনীতে আল-কায়েদা ঢুকে পড়েছে, সেখানে শান্তি বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভবও বটে।
হিনার সফরকে ভারতের নীতিনির্ধারকেরা ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন। তারা মনে করেন, নিজ দেশের মানুষের রক্ত দেকে দেখে ক্লান্ত শাসকেরা নিরুপায় হয়ে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন। তা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতি পরিবর্তনের কারণে দেশটির আঞ্চলিক গুরুত্বও কমে গেছে। কেবল আফগানিস্তান নয়, প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গেও চলছে টানাপোড়েন। এ অবস্থায় ইসলামাবাদের জন্য দিল্লির সহযোগিতা জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে হিনা রব্বানি খার ‘দিল্লি’ জয় করতে না পারলেও দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক মোড় ঘুরিয়েছেন বলা যায়। ‘আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাস’ নিয়ে দেশে ফিরে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটাই বা কম কিসে।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনই দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ। তাদের মধ্যকার সন্দেহ-অবিশ্বাসের প্রভাব পড়ছে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশেও। দক্ষিণ এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক না হওয়ায় সার্ক কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি।
উপমহাদেশে যত জঙ্গি তৎ পরতা চলছে, তার সঙ্গে কোনো কোনোভাবে পাকিস্তানি জঙ্গিদের যোগসাজশ আছে। সেটি মুম্বাইয়ের বোমা হামলা কিংবা ঢাকায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় প্রমাণিত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হলো পাকিস্তান সরকারে জঙ্গি পোষণ ও আইএসআই তোষণনীতির অবসান। সরকার ও প্রশাসনে আইএসআইয়ের যে সর্বগ্রাসী দৌরাত্ম্য রয়েছে, তা খর্ব করা। তাতে পাকিস্তান নিজে যেমন বাঁচবে, তেমনি অন্যদের বাঁচতে সাহায্য করবে।
প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানি শাসকদের সেই সুমতি হবে কি না?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎ ab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.