রাজনীতি-অলির বলি আর রাজনীতির গলায় গামছা! by বদিউর রহমান

উত্তর মনে হয় সোজা, উত্তর মনে হয় একটাই আর সেটা হচ্ছে_ নীতিতে থেকেই হোক আর নীতি বিসর্জন দিয়েই হোক আগামী নির্বাচনে কারও জন্য টিকে থাকার আর কারও জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ এখন থেকেই প্রশস্ত করে নিতে হবে। এ টানাটানিতে একেক দলের এবং নেতার একেক রকম হিসাব রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি তো রয়েছেই।


হ্যাঁ, রাজনৈতিক কৌশল এমন হতেই পারে। রাজনীতিতে চিরবন্ধু আর চিরশত্রু নেই বলেই তো রাজনীতিকরাই যখন যেমন, তখন তেমন সুযোগ নিয়ে দল পাল্টান, মত বদলান, আবার নতুন ঘরে 'সংসার' করেন, নতুন নেতৃত্ব মেনে নেন, কখনওবা ঘরের মানুষ
আবার ঘরে ফেরেন

রাজনীতির সুন্দর অর্থ এখন আর এককভাবে সুন্দর থাকছে না। রাজনীতিকদের হরেক রকম অপকীর্তি এবং স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ডে রাজনীতির যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জেও রাজনীতি শব্দটাকে কদার্থেও ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হয়, না আর পারা গেল না রাজনীতির মধ্যেও পলিটিক্স ঢুকে গেছে। হালে তো এ রাজনীতিকে নিয়েই পলিটিক্স শুরু করেছে বড় বড় রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিকরাই। ২৩, ২৪, ২৫ জুলাই ২০১১-এর পত্রিকাগুলোতে রাজনীতির হালহকিকতের কয়েকটি খবর দেখলে এমন ভাবার অবকাশ রয়েছে যে বড় দলগুলো ছোট দলকে নিজ আওতায় পেতে ব্যস্ত আর রাজনীতিকরাও যে যেমন ইচ্ছা চেষ্টা চালাচ্ছে কিংবা লাগামছাড়া কথাবার্তাও বলছেন। 'ছোট দলের দ্বারে দ্বারে ঘোরায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দৈন্যই ফুটে উঠেছে।' 'রাজনীতিতে এখন ফুরফুরে মেজাজে ছোট দলগুলো_ বড় দল আওয়ামী লীগ, বিএনপির নজর পড়ছে' (আমার দেশ, ওই)। ২৪ জুলাই প্রথম আলোর লিড নিউজ 'বড় দুই দলের ডাকাডাকি-কদর বাড়ছে ছোট দলের' এবং ২৫ জুলাই যুগান্তরের লাল হেডিং 'ভোটের অঙ্কে নেই তারা_ আছেন জোটের অঙ্কে।' কিন্তু কেন হঠাৎ করে ছোট দলগুলোকে বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এভাবে ঘরে ঘরে গিয়ে ডাকা শুরু করেছে? কেনইবা ড. কামাল, এরশাদ, ড. অলি, বদরুজ্জোদা চৌধুরী এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীরাও এসব ডাকে সাড়া দিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন? উত্তর মনে হয় সোজা, উত্তর মনে হয় একটাই আর সেটা হচ্ছে_ নীতিতে থেকেই হোক আর নীতি বিসর্জন দিয়েই হোক আগামী নির্বাচনে কারও জন্য টিকে থাকার আর কারও জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার পথ এখন থেকেই প্রশস্ত করে নিতে হবে। এ টানাটানিতে একেক দলের এবং নেতার একেক রকম হিসাব রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি তো রয়েছেই।
হ্যাঁ, রাজনৈতিক কৌশল এমন হতেই পারে। রাজনীতিতে চিরবন্ধু আর চিরশত্রু নেই বলেই তো রাজনীতিকরাই যখন যেমন, তখন তেমন সুযোগ নিয়ে দল পাল্টান, মত বদলান, আবার নতুন ঘরে 'সংসার' করেন, নতুন নেতৃত্ব মেনে নেন, কখনওবা ঘরের মানুষ আবার ঘরে ফেরেন। এতে প্রয়োজনে কেউ হয়তো 'রাজনৈতিক হিল্লা'ও সেরে নেন। পাকিস্তান আমলের পর বাংলাদেশ আমলে এ চর্চা বেড়েছে, বেড়েই চলেছে। কার অধীনে কে নির্বাচনে যাবে, এক দলের প্রতীক নিয়ে অন্য দলও জোটবদ্ধ হিসেবে নির্বাচন করবে কি-না, দলীয় সরকার না তত্ত্বাবধায়কের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন মেনে নেবে_ সবই যার যার অঙ্কের হিসাব নিয়েই বিবেচ্য হবে। আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে তাদের অধীনে পরবর্তী নির্বাচন করতে চায় বলেই তো সংবিধান সংশোধন করেছে। বিএনপি এবং অন্যান্য ছোটখাটো দল তত্ত্বাবধায়ক চায়, কারণ তারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু ভাবতে পারছে না। ফলে আওয়ামী লীগের এখন কিছু মুখচেনা বড় নেতা দরকার, তাদের ভোটব্যাংক না থাকুক তাতে কিছু আসে যায় না, তাদের নিজ নিজ ব্যক্তি ইমেজটাই কাজে লাগবে। অন্তত বিরোধী দলে যাওয়া ঠেকানো গেলেও তো অনেক পাওয়া। এ পলিটিক্সে বড় দু'দলেরই প্রথম লক্ষ্য স্বাধীনতা-পরবর্তী থেকে শুরু করে এ যাবৎকালে যারা মূল দল থেকে বা নিজ ঘরানা থেকে ভিন্ন হয়েছেন, আলাদা হয়েছেন, নতুন দল গঠন করেছেন অথবা অন্য দলে গিয়েছেন তাদের নিজ ঘরানায় নিয়ে আসা। দল বিলোপ করে তা সম্ভব করা হয়তো কষ্টকর, প্রত্যেকের মানমর্যাদার ব্যাপার রয়েছে। অতএব দল রেখে আমাদের সঙ্গে হলেই চলবে। দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে নিজ ঘরানার বাইরের কাউকেও যদি নিয়ে আসা যায় তাতে তো আরও লাভ। কিন্তু বিএনপি যদি বেশি সুবিধা দিয়ে তাদের ফুসলাতে পারে তাতে দোষের কিছুই নেই, কেননা রাজনীতি তো রাজনীতিই, এর মধ্যে পলিটিক্স তো থাকবেই। এরশাদ রবকে গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা করতে পেরেছেন, শেখ হাসিনাকে '৮৬-এর নির্বাচনে নিতে পেরেছেন; শেখ হাসিনাও এরশাদকে খালেদা থেকে আলাদা করে নিজের মহাজোটে নিয়ে তুরুপ চাল চেলেছেন, বামদের তার নিজ দলীয় মার্কা নৌকায় 'ডুবাতে' সক্ষম হয়েছেন, এমনকি একবার তো মোল্লাদের একাংশের সঙ্গেও চুক্তি করেছেন। খালেদা তো নিজামী গংয়ের আওয়ামী সখ্য থেকে বের করে নিজের কাছে টেনেছেন। মওদুদ গং বারবার 'ঘর' বদলিয়েছেন, তার রাষ্ট্রপতি হওয়া পূর্ণ হলেই কোর্স কমপ্লিট_ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি সবই তো ছিলেন তিনি।
অলির হিসাব সোজা, আগামী নির্বাচনে যদি নিজের একমাত্র আসনটাও চলে যায় তাহলে তিনি আর থাকলেন নাকি? অতএব খালেদা-তারেক বন্দনা করে হলেও শেষ রক্ষা চাই আর ওখানে না গেলে আওয়ামী লীগ যদি ঠাঁই দেয় তাও বোধহয় মন্দ হয় না। অতএব নিজেকে তিনি 'বলি' দিতে আর দ্বিধা করতে চান না। এখন শুধু অঙ্ক কষা_ কোনদিকে লাভ বেশি এবং নিশ্চিত লাভ চাই। কী হয়েছে খালেদাকে গালমন্দ করে দল থেকে বেরিয়েছেন? আবার কদমবুসি করলেই তো হলো! তিনি স্মরণ করতেই পারেন জিয়া তাকে রাজনৈতিক সুযোগ দিয়েছেন। অতএব জিয়ার ছেলে তারেককে মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? ডক্টরেট করে তিনি আরও প্রাজ্ঞ হয়েছেন, কাঁচা কাজ তিনি অবশ্যই করবেন না। তিনি রাজি হলে বিএনপির অনেক পুরনোরাই তার সঙ্গে রক্ষা পাবেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরী তো আদি ও আসল বিএনপি, জিয়ার বড় পছন্দের দলীয় মহাসচিব। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়ার সঙ্গে তিনি যে বিদায় হননি এটাই তো এক বিরাট রহমত। অতএব রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিতাড়িত হয়ে নিজ ছেলে আর মান্নানকে (মেজর) নিয়ে বিকল্পধারা করে তো কোনো বিকল্প আজও বের করতে পারেননি, এখন যদি খালেদা জিয়া আবার ঠাঁই দেন হারানোর তো কিছুই নেই, প্রয়োজনে তিনিই আবার রাষ্ট্রপতি হলেন। অন্তত মাহীর তো একটা হিল্লে হবে। আওয়ামী জোটে এলেও তিনি সম্মান পাবেন, মাহী তো শেখ হাসিনার জন্য গেট করে আগেই সুসম্পর্ক রেখেছেন। কিন্তু একা একা আর বোধহয় সুবিধা হচ্ছে না। অলি যদি 'বলি' হতে চান স্বেচ্ছায়, বদরুদ্দোজার আপত্তি থাকবে কেন? খালেদা জিয়া যদি বিএনপি ঘরানার সবাইকে নিতে পারেন তবে সেটা হবে এক বড় সার্থকতা, আওয়ামী লীগকে মোকাবেলার কিছুটা প্রচেষ্টা।
পুরনো পত্রিকা দেখলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর গৌরবগাথা মনে পড়ে যায়। ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর দৈনিক বাংলাদেশে (পাকিস্তান কেটে এভাবেই পত্রিকার নাম ছেপেছিল) ১৮ ডিসেম্বরের পল্টনের প্রথম সভায় 'বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দাও' ঘোষণায় 'ব্রিগেডিয়ার' আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সেই ছবি, একই তারিখের রোববারের পূর্বদেশে তার বিশাল জনসভায় বক্তৃতারত সে কী ছবি এবং ঘোষণা_ শেখ মুজিবকে মুক্তি দাও, একই তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকেও একই গৌরবময় ছবি তার। সেই কাদের সিদ্দিকী পরে কোথায় চলে এলেন! তিনি বলেন চমৎকার, হালে লেখেন আরও চমৎকার, 'তিনি আমার বড় ভাই'। কিন্তু এখন কি ভগি্নর সঙ্গে যাবেন? খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন না করার অনুরোধ করেছেন তাকে, তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা তার বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন। হাসিনার দাওয়াতও কবুল করেছেন, দেখা করবেন। অলি সাংসদ বললেও কাদের সিদ্দিকী এবার তাও নেই। তিনি কি অস্তিত্বের জন্য এবার ঝোঁক দেবেন কোনোদিকে? পরবর্তী সময়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন সেটা তার 'পাত্রী দেখার' ওপর হয়তো নির্ভরশীল, দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফসল হবে। তবে আপাত তাকে এ চরম সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলা যায় নিঃসন্দেহে। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি_ উভয়ের গলায় গামছা দিয়েছেন, খোদ খালেদাকেও তার স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছেন, হাসিনাকেও হয়তো দিতে পারবেন। গলায় গামছা দেওয়া গ্রামাঞ্চলে ভিন্নভাবে দেখা যায়, দেশের রাজনীতির গলায় গামছা দিয়ে তিনি এবার গিট্টু দিয়ে হ্যাঁচকা টান দিতে পারবেন কি-না তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম আমরা। হায়রে রাজনীতি আমাদের!

বদিউর রহমান : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের
সাবেক চেয়ারম্যান
 

No comments

Powered by Blogger.