সন্তান নিয়ে অপবাদ এবং ওয়ারেন্ট জারির গল্প by তানজিম আল ইসলাম

দিনাজপুরের মেয়ে বিলকিস বেগমের বিয়ে হয় ২০০৮ সালে, পারিবারিকভাবে। এক ঘটকের মাধ্যমে বিয়েটি হয়। ঘটক বিয়ের সময় ছেলের বাড়ি সম্পর্কে অনেক সত্য গোপন করেছিলেন। বিলকিসের পরিবার এত কিছু যাচাই-বাছাই করেনি। কিন্তু বিয়ের পর থেকে বিলকিসের স্বামী তাঁকে মেনে নিতে পারেননি।


তবু ভাগ্যের লিখন মনে করে বিলকিস ঘর করতে থাকেন স্বামীর সঙ্গে। ধরে নেন, এভাবেই কেটে যাবে দিন। স্বামীর অবহেলাকে দুর্ভাগ্য মনে করেই সব সহ্য করে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই তাঁর ওপর নেমে আসে আরেক অন্ধকার। বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই গর্ভধারণ করেন বিলকিস। কিন্তু এ সন্তানের কথা জানাজানি হতে না হতেই তাঁর ওপর নেমে আসে নানা অপবাদ। তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মিলে সন্দেহ শুরু করেন তাঁর অনাগত সন্তানকে নিয়ে। বিলকিস যখন নয় মাসের গর্ভবতী, তখন তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী মিলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। তখন থেকেই বিলকিস তাঁর বাবার বাড়িতেই আছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়।
বিলকিস শিক্ষিত মেয়ে। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর ভরণপোষণের জন্য প্রতিবাদ করতে থাকেন। এর মধ্যে শুনতে পান যে স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। বিলকিসের স্বপ্নের পৃথিবীটার যতটুকু অবশেষ ছিল, তা-ও যেন নিমেষেই শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যেই তাঁর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে একটি ছেলে। শুরু হয় বিলকিসের নতুন লড়াই—ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। তিনি স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে আপস-মীমাংসারও চেষ্টা করেন ছেলেটির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কোনো সুরাহা পেলেন না। উল্টো তাঁর ওপর জুটল আরও অপবাদ। এই ছেলেকে অস্বীকার করতে লাগলেন তাঁর স্বামী এনামুল। বিলকিসদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কোনোভাবে দিন চলে তাঁর বাবার। মেয়েটির ভাষায়, তিনি যেন বোঝা হয়েই থাকেন বাবার বাড়িতে। কিন্তু উপায় যে নেই। ছেলেকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন? বিলকিস তাঁর ও সন্তানের অধিকারের জন্য সহযোগিতা চেয়ে আইন অধিকারের কাছে চিঠি লেখেন।
বিলকিসের সঙ্গে ফোনে কথা হয় অনেকক্ষণ। তাঁর জীবনকাহিনি জানতে চাই তাঁর মুখেই। তিনি বলতে থাকেন তাঁর অসহায়ত্বের কথা। পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও বিয়ের পরপর কেন এমন বদলে যাবে তাঁর স্বামী—এ এক রহস্যই তাঁর কাছে। বিলকিসের ভাষায়, ‘স্বামীর কথামতো চলতাম, সবার দেখাশোনা করতাম, বাচ্চাও নিলাম ওর মর্জিমতো, তবু আমার জীবনটা এত অভিশপ্ত কেন?’
জানতে পারি, বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই যৌতুকের জন্য চাপ দিতে থাকে বিলকিসকে। কিন্তু মেয়েটি কোথা থেকে দেবেন টাকা। এ কথা বললেই তাঁর ওপর চলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। নয় মাসের গর্ভবতী থাকার সময় তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁর গর্ভে থাকা সন্তানের বাবা কে, এ নিয়ে দেওয়া হয় অপবাদ। বিলকিস এরপর আর থেমে থাকেননি। একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সন্তানের এবং নিজের ভরণপোষণ চেয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। মামলার সমন গেলেও তাঁর স্বামী আদালতে জবাব দাখিল করেননি। মামলা চলতে থাকে মামলার গতিতে। কয়েক মাস পর একতরফা রায় আসে মেয়েটির পক্ষে।
জিজ্ঞেস করি, এ মামলার রায় আসার পর কী হলো?
‘মামলার ডিক্রি জারির জন্য আবেদন করি। মামলায় ওয়ারেন্ট জারি হয় আমার স্বামীর বিরুদ্ধে।’
আপনার স্বামী কি পরে আদালতে হাজির হন?
‘এরপর মামলার রায় আসার পর এবং ওয়ারেন্ট জারি করার কথা জেনে আমাকে তালাকের নোটিশ পাঠায়। তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর আমি অনেক অসহায় হয়ে যাই। শুধু ভাবতে থাকি, এ দেশে আমাদের মতো অসহায় নারীদের পাশে কি কেউ নেই? ইচ্ছা করলেই স্বামী যখন-তখন তালাক দিতে পারে। কিন্তু আমি কি আমার নিজের আর আমার সন্তানের অধিকার পাব না?’
আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারির পর পুলিশ যায়নি তাঁকে আদালতে হাজির করতে?
‘আমার স্বামী কোর্টে এসে এ রায়ের বিরুদ্ধে ছানি মোকদ্দমা দায়ের করেন।’
কোর্টে কী আদেশ এল?
‘কোর্ট ওয়ারেন্টটি বাতিল করে দেন শুরুতেই। পরে মামলার রায় খারিজ হয়ে যায়। পরে আবার ওয়ারেন্টের জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু কোনো পুলিশ তাঁকে আটকের জন্য যায়নি।’
আপনি কি জানেন যে স্বামী আপনার অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, এ জন্যও আদালতে যেতে পারতেন?
‘না, জানতাম না। আর আমি তো আমার ন্যায্য দেনমোহর আর তাঁর সন্তানের ভরণপোষণই পাচ্ছি না। আইনের আশ্রয় নিলাম, আদালতের রায়ও এল, ওয়ারেন্ট জারি হলো। তা-ও আমার আর আমার ছেলের কোনো কূলকিনারা করতে পারছি না। কী লাভ হলো আইনের আশ্রয় নিয়ে? আমি আর কার কাছে যাব? আমি আমার দেনমোহর আর ছেলের ভরণপোষণ পাব—এটা তো আমার পাওনা। এই ছেলে নিয়ে এত অপবাদ সইতে হচ্ছে। ওপরে খোদা আছেন, তিনিই জানেন এ সন্তানের বাবা আমার স্বামী।’
বেসরকারি সংস্থাটি কী বলছে এখন?
‘তারা তো চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়ারেন্ট জারি না হলে তাদের কিছু করার নেই বলে তারা বলছে।’
আপনার তো যৌতুকের জন্যও মামলা করার সুযোগ ছিল যৌতুক নিরোধ আইনে।
‘আমি এত কিছু তো বুঝি না। এনজিওর উকিলেরা যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই মামলা করেছি।’
বিলকিসের পাঠানো চিঠির শেষ অংশে লেখা, ‘আমার মোহরানা, এত দিনের আমার ও সন্তানের খোরপোষ—কিছুই কি আমি পাব না? গরিবের টাকা নেই বলে আইন-আদালত কেউ নেই? সন্তানকে জন্ম দিয়ে যে অস্বীকার করে, তার বিচার করার জন্য কি কেউ নেই?’

পাদটীকা: স্ত্রীর দেনমোহর আর স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণ চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়। মামলায় যদি বিবাদী পক্ষ হাজির না হয়, তাহলে আদালত একতরফা বিচার করতে পারেন এবং একতরফা ডিক্রি দিতে পারেন বাদীর পক্ষে। বিবাদী পক্ষ একই আদালতে এসে এই একতরফা ডিক্রি বাতিল চেয়ে আবেদন করতে পারে। একেই ছানি মোকদ্দমা বলা হয়। ছানি মোকদ্দমার মাধ্যমে মোকদ্দমা পুনর্বহালের আবেদন করা হয়। মূলত দেওয়ানি কার্যবিধিতে ছানি মোকদ্দমা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেহেতু পারিবারিক আদালতে দেওয়ানি কার্যবিধি প্রয়োগ হয় না, তাই পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশেও ছানি মোকদ্দমার বিধান আছে। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী একতরফা ডিক্রি হলে ডিক্রি প্রদানের পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে ছানি মোকদ্দমা করতে হয়।
কোনো মামলায় ডিক্রি হলে ডিক্রি জারির জন্য আবেদন করতে হয়। একে ডিক্রি জারির মোকদ্দমা বলা হয়। ডিক্রি জারির ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনে এবং ফৌজদারি মামলার মতো ওয়ারেন্ট জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.