ধর্ম-মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তা ৎপর্য by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মাহে রমজান উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতিশ্রুত বেহেশত লাভের সওগাত। ‘রামাদান’ শব্দটি আরবি ‘রাম্দ’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা। রমজান মাসে সিয়াম সাধনা তথা রোজাব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে


আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্রপূর্ণ জীবন যাপন করে এবং ষড়িরপুকে দমন করে মহান আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। মাহে রমজান মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এই মহিমান্বিত মাসের নাম রমজান। অসাধারণ ফজিলত ও তা ৎপর্যপূর্ণ মাহে রমজানে সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের ঈমানি চেতনা সুদৃঢ় হয়, তাকওয়া বা আল্লাহভীতির নিদর্শন প্রকাশ পায় এবং অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।
ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হচ্ছে রোজা। নামাজের পরেই মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তাআলা যে ইবাদত ফরজ করেছেন, তা হচ্ছে মাহে রমজানের রোজা। দ্বিতীয় হিজরি সালে উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়। তবে এই রোজা অন্যান্য জাতির ওপরও ফরজ ছিল। ইসলামের অন্যান্য বহু আদেশ-নির্দেশের মতো রোজাও ক্রমিক নিয়মে ফরজ হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কেবল মাহে রমজানে রোজা নির্দিষ্ট ও এতেই সীমাবদ্ধ করে দেননি, বরং শরিয়তসম্মত কোনো অনিবার্য কারণবশত কেউ রমজান মাসে রোজা পালন করতে না পারলে অন্য যেকোনো সময় রোজার কাজা আদায় করার পথও আল্লাহ তাআলা উন্মুক্ত রেখেছেন। মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাসে মানুষের দিশারি এবং স ৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। আর কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না, এ জন্য যে তোমরা (রোজার) সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের স ৎ পথে পরিচালনা করার কারণে তোমরা আল্লাহর মহিমা কীর্তন করবে, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫)
একদা নবী করিম (সা.) মাহে রমজানের প্রাক্কালে বলেন, ‘রমজান মাস আগত প্রায়, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, আল্লাহ তাআলা বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করেন এবং খাস রহমত বর্ষণ করেন, গুনাহ মাফ করেন এবং দোয়া কবুল করেন।’ তাই রমজান মাস ইসলামের অনুসারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিরাট নিয়ামত। এ নিয়ামতের কদর করা না হলে মাহে রমজানের কোনো মূল্য বা মর্যাদা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় না।
বস্তুত, মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মোবারক, রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এই মহান মাসে পবিত্র কোরআন মজিদ নাজিল হয়েছে। রমজান মাসের সম্মানজনক মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস আগত হয় তখন আকাশ বা বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা বন্ধ করা হয় না, আর দোজখের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, সারা রমজান মাসে তা খোলা হয় না, আর শয়তানকে জিঞ্জিরে বন্দী করা হয়।’ (তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজা)
আত্মিক উ ৎকর্ষ ও পরকালীন কল্যাণ লাভের এক বেহেশতি সওগাত এই রমজান মাস। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত আছে যে তা ৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতময় পবিত্র মাহে রমজানে রোজা পালনকারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলা পুরস্কারের ভান্ডার নির্ধারণ করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন: আদম সন্তানের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, তবে রোজা ব্যতীত, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
শাবান মাসকে রমজান মাসের প্রস্তুতিমূলক মাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শাবান মাসের সমাপনান্তে মাহে রমজানের এক ফালি রুপালি চাঁদ পশ্চিম আকাশে উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন একজন মুমিন মুসলমান মনে ইস্পাতকঠিন ঈমান ও ব্যাপক উ ৎসাহ-আগ্রহভরে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে নিয়ত করে ফেলেন ও রোজা আদায়ে মশগুল হয়ে যান, তখনই তিনি মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতের চাদর দ্বারা আবৃত হয়ে পড়েন। ফলে ইহজগতের শান্তি ও পারলৌকিক কল্যাণ ও মুক্তির সনদ তাঁর জন্য ঘোষণা করা হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি ভালো কাজের সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: কিন্তু রোজার ব্যাপারে এর ব্যতিক্রম হবে। কেননা বান্দা আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য রোজা রেখেছে এবং আমি নিজেই এর প্রতিফল দান করব। সে তো আমার জন্যই কামনা-বাসনা ও খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’ (মুসলিম)
মাহে রমজান এমন এক বরকতময় মাস, যার আগমনে পুলকিত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামদের মোবারকবাদ পেশ করতেন এবং এ মর্মে সুসংবাদ প্রদান করেছেন, ‘তোমাদের সামনে রমজানের পবিত্র মাস এসেছে, যে মাসে আল্লাহ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন।’ (মুসলিম) অন্য এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মত যদি মাহে রমজানের গুরুত্ব বুঝত, তাহলে সারা বছর রমজান কামনা করত।’ সুতরাং এ শ্রেষ্ঠতম মাসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপানে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্যকর্তব্য।
পবিত্র মাহে রমজানের অসীম কল্যাণ ও বরকত লাভের প্রত্যাশার জন্য আগে থেকে সবার দৈহিক ও মানসিকভাবে ইবাদতের প্রস্তুতি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে তখন একজন আহ্বানকারী আহ্বান করেন, ‘হে কল্যাণকামী এগিয়ে যাও! হে মন্দান্বেষী স্তব্ধ হও!।’ (তিরমিজি) আল্লাহ তাআলা আমাদের মাহে রমজানের গুরুত্ব, তা ৎপর্য ও ফজিলত সঠিকভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে এ মাসে সিয়াম সাধনার দ্বারা যাবতীয় কল্যাণ, অসীম রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের তাওফিক দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
d ৎ.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.