বিশেষ সাক্ষাৎকার-মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আফগানিস্তানের বড় চ্যালেঞ্জ by কামাল হোসেন

গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ১৯৫৭ সালে অক্সফোর্ড থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর এবং ১৯৬৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ১৯৫৯ সালে লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও পরে আইনমন্ত্রী হন।


১৯৭৩-৭৫ সালে যথাক্রমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জ্বালানি সম্পদমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর তিনি অক্সফোর্ডের অল সউলস কলেজে ভিজিটিং ফেলো হন। ১৯৯০-৯১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৪-০৫ সালে তিনি সমুদ্রসীমানা নিয়ে ‘মালয়েশিয়া বনাম সিঙ্গাপুর’ এবং ‘গায়ানা বনাম সুরিনাম’-এর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারক ছিলেন। ১৯৯৮-২০০৩ সালে ড. কামাল হোসেন আফগানিস্তানবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ছিলেন। সর্বশেষ চার সদস্যের ইউএনডিপির মিশনপ্রধান হিসেবে গত ১৩-১৯ জানুয়ারি তিনি কাবুল সফর করেন।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো  আফগানিস্তান সফরে গিয়ে এবার আপনার অভিজ্ঞতা কী?
ড. কামাল  এর প্রেক্ষাপট একটু খুলে বলতে হবে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনারা চলে গেল। তখন দেশটি যাতে একটি সত্যিকারের বহুজাতিগত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, সে জন্য জাতিসংঘ উদ্যোগ নিল। আফগানিস্তানে জাতিগত বিভেদ খুবই শক্তিশালী। ইরান, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছিল। সোভিয়েত সেনাদের আফগানিস্তান ত্যাগের ১০ বছর পর ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার (মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের বিশেষ দূত) হিসেবে আমি সেখানে যাই। তখনো বাইরের মদদে গৃহযুদ্ধ কিংবা জাতিগত দাঙ্গা চলছে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমি বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর পরিদর্শন করেছি। এমনও সময় গেছে, যখন দুই ঘণ্টার জন্য রকেট শেল নিক্ষেপ বন্ধ করা হয়েছে, এর মধ্যে আমরা কাবুলে বৈঠক করেছি। প্রলম্বিত গৃহযুদ্ধ ও হানাহানি ৬০ লাখ শরণার্থী সৃষ্টি করেছিল। ইরান ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় তাঁরা অবস্থান নিয়েছিল।
প্রথম আলো  সেই সময়ের চেয়ে এবার কী পরিবর্তন দেখলেন?
ড. কামাল  আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, শান্তি প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে মানবাধিকার লঙ্ঘন চলতে থাকবে। পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু তা এখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে। তার প্রমাণ, এখনো ৪০ লাখ শরণার্থী রয়ে গেছে। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলা (নাইন-ইলেভেন) আফগান জাতীয় জীবনে বিরাট পরিবর্তন সৃষ্টি করে। এর আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগান পরিস্থিতি ও সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে তেমন নজর দিচ্ছিল না। ১৯৭৯ থেকে তখন পর্যন্ত দেশটির আসলে কোনো কার্যকর সরকার ও সংসদ ছিল না। ২০০১ সালে জার্মানির বনে একটি চুক্তি হলো। নতুন করে রাষ্ট্র গঠন ও সে জন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা ছিল মূল লক্ষ্য।
প্রথম আলো  আপনি তখন কী ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন?
ড. কামাল  তখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল জাতীয় সমাবেশ কে ডাকবে। তখন আমি জাতিসংঘ র‌্যাপোর্টিয়ার হিসেবে আফগানিস্তানের নির্বাসিত বাদশা জহির শাহের সঙ্গে ইতালির রোমে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাঁর কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম যে আপনি বিবদমান দল ও গোষ্ঠীগুলোর কাছে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিন। জহির বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় যেতে চান না। তবে তাঁর দেশের নির্যাতিত মানুষের কষ্ট লাঘবে কোনো ভূমিকা রাখতে পারলে তিনি খুশি হবেন। তাঁর নামেই জাতীয় সমাবেশ আহ্বানে আমন্ত্রণপত্র বিলি করা হয়েছিল।
প্রথম আলো  এখন জাতিসংঘ আপনাকে কেন আফগানিস্তানে পাঠাল?
ড. কামাল  চার সদস্যের একটি ইউএনডিপি মিশনের আমি প্রধান ছিলাম। মানবাধিকারের প্রতি সবার সুবিধালাভে ২০১২-২০১৪ সালের জন্য একটি কৌশলগত খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন করা ছিল লক্ষ্য। একজন ব্যাংকক থেকে ও দুজন এসেছিলেন নিউইয়র্ক থেকে। আফগানিস্তানের প্রথম স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বনচুক্তির পরই। এবার আমি কাবুলে সাত দিন (১৩-১৯ জানুয়ারি, ২০১২) থেকেছি। প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সহায়তা দিচ্ছে, তাকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রথম আলো  এ মুহূর্তে আফগানিস্তানের বড় চ্যালেঞ্জ কী?
ড. কামাল  মানুষের নিরাপত্তার যে ঘাটতি বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠাই এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো পুরো দেশের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।
প্রথম আলো  জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সত্যিই কি কাজ করতে পারছে?
ড. কামাল  তারা অনেক ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে উজ্জ্বল তিনি হলেন ড. সিমা সামার। ১৩ বছর আগে তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম কোয়েটার কাছে, বেলুচিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী একটি উদ্বাস্তু হাসপাতালে। তিনি সেখানে শরণার্থীদের জন্য একটি হাসপাতাল পরিচালনা করছিলেন। ওই সময় আমি বিভিন্ন উদ্বাস্তু কেন্দ্র ঘুরে জাতিসংঘে রিপোর্ট পাঠাতাম।
প্রথম আলো  ড. সীমা সামারের কথা বিস্তারিত বলুন। নারী হয়ে এত বৈরী অবস্থায় তিনি কীভাবে সামাল দিচ্ছেন?
ড. কামাল  ২০০২ সালে তিনি হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বাধীন প্রথম ক্রান্তিকালীন সরকারে ডেপুটি প্রেসিডেন্ট ও পরে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রী হন। কিন্তু তাঁর বিশেষ মনোযোগ ছিল মানবাধিকারে। তাই তিনি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন। আমি যখন কাবুলে এই কমিশনের দপ্তর প্রথম পরিদর্শন করেছিলাম, তখন সেটা নিতান্ত সাদামাটা ছিল। একটা কার্পেটের ওপর বসে আমরা আলোচনা করেছিলাম। ১২ বছর পর দেখলাম অনেক উন্নতি ঘটেছে। লোকবল বেড়ে ৬০০ হয়েছে। সারা দেশে তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি দেশের সব মহলের আস্থা অর্জন করেছেন। আফগানিস্তানের অন্তত সর্বজনশ্রদ্ধেয় একটি উচ্চকিত কণ্ঠ রয়েছে। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন।
প্রথম আলো  তাঁর সংস্থার প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত প্যাট্রিসিয়া গসম্যান গত ২৬ ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, কমিশনের আসন্ন রিপোর্টে সরকারের ভেতরে যাঁরা আছেন, তাঁদের কেউ কেউ নির্দিষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন। আপনার মতে, আফগান মানবাধিকার কমিশনের সবচেয়ে বড় অর্জন কী?
ড. কামাল  সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেসব সরকারি সংস্থা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে তাঁর কমিশন শীর্ষে রয়েছে বলে মনে করি। যতদূর জানি, তারা ইতিমধ্যে দুটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে কমিশন বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাদের রিপোর্টে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি যাঁরা এখনো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারছেন, তাঁদের সংশ্লিষ্টতার বিষয় উল্লেখ থাকতে পারে।
প্রথম আলো  আফগানিস্তানের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আপনি কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন?
ড. কামাল  ১৩ জানুয়ারি ২০০৩ জাতিসংঘের কাছে আমি যে রিপোর্ট দিয়েছিলাম, তাতে এ বিষয়ে উল্লেখ ছিল। জাতিসংঘ যাতে এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয় সে জন্য আমি বলেছিলাম, এ জন্য সর্বাগ্রে দরকার মানবাধিকার কমিশন, যাতে উপযুক্ত শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। আমি এ প্রসঙ্গে ট্রানজিশনাল জাস্টিস বা ক্রান্তিকালীন বিচার কথাটি উল্লেখ করেছিলাম। বলেছিলাম, এ প্রক্রিয়ার উন্নয়নের জন্য একটি জাতীয় কৌশল উদ্ভাবন ও তার সমন্বয় সাধন হলো পূর্বশর্ত।
প্রথম আলো  এর অগ্রগতি কতদূর? উল্লেখযোগ্য বলা যায় কি?
ড. কামাল  চেষ্টা এখনো অব্যাহত। আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেখানে যে যুদ্ধাপরাধ ঘটেছিল, তার একটা আইনানুগ নিষ্পত্তি প্রয়োজন।
প্রথম আলো  প্রতিবেশী দেশগুলোর তরফে আপনি কী ভূমিকা আশা করেন?
ড. কামাল  সব প্রতিবেশীর উচিত আফগানিস্তানে এখন যারা গৃহবিবাদে লিপ্ত এবং সংঘর্ষের জন্য দায়ী, সে সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সহযোগিতা না দেওয়া। তারা যেন কোনোভাবেই অস্ত্র না পায় এবং জাতীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো বাহিনী যাতে না থাকে, সেটা নিশ্চিত করা। এসবই কারজাই সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, ওই সব সরকারবহির্ভূত গোষ্ঠীকে নিরস্ত্রীকরণের সহযোগিতা দেওয়া।
প্রথম আলো  আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোসহ বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. কামাল  গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি ও রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এখন অব্যাহত রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকর হতে পারেনি বলে তারা আন্তর্জাতিক বাহিনী ও তাদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সে কারণে ৩০ হাজার সেনা বাড়িয়েছে। ২০১৪ পর্যন্ত বহুজাতিগত বাহিনীর থাকার কথা।
প্রথম আলো  সার্কে আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কতটা সহায়ক?
ড. কামাল  এটা খুবই ভালো পদক্ষেপ হয়েছে। আফগানিস্তান ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়ে আসছে। রাশিয়ার জারের সঙ্গে ব্রিটিশরা চুক্তি করেছিল যে আফগানিস্তান একটি ‘বাফার স্টেট’ হয়ে থাকবে। সেই চুক্তি শান্তি এনেছিল। দেশটি তখন সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেছিল। তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অনন্যসাধারণ। সে কারণেই আফগানিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠা আমাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। সুতরাং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ অঞ্চলের দেশগুলোর দায়িত্ব রয়েছে।
প্রথম আলো  প্রসঙ্গক্রমে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে আফগানিস্তানের ভূমিকা কী ছিল?
ড. কামাল  জহির শাহ তখন ক্ষমতায়। তাঁর সরকার প্রত্যক্ষভাবে না হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অনেক বাঙালি জালালাবাদ ও কাবুল হয়ে নিরাপদে পাকিস্তান ত্যাগ করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দীন আহমদ, আবুল আহসানসহ অনেকেই আফগানিস্তান হয়ে দেশে এসেছিলেন।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. কামাল  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.