জাদুঘর এখনও হয়নি by সুমন কুমার দাশ

আজ ১২ সেপ্টেম্বর। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৯ সালের এই দিনে সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। কিংবদন্তিতুল্য এ সঙ্গীত সাধকের মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
মানুষ চলে গেলে স্মৃতিটুকু থাকে স্মরণীয় হয়ে। তাই লেখার শুরুটা ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতিচারণা দিয়ে। ২০০৭ সাল। আমার সম্পাদনায় ঢাকার উৎস প্রকাশন থেকে 'শাহ আবদুল করিম সংবর্ধনা গ্রন্থ' প্রকাশ হয়। বাউলসম্রাটের হাতে আমি বইয়ের প্রথম কপিটি তুলে দিই। বইটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে-চেড়ে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'বই! বইটা ভালো অইছে। কিন্তু কভারে আমার মাথাটা কাটা কেনে?'
বাউলসম্রাটের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, 'চাচা, এটা কিন্তু মাথা কাটা নয়। কভারে যে ছবিটি স্থান পেয়েছে সেটি তুলেছেন দেশের একজন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। ছবিটি তিনি এভাবেই তুলেছেন। এটি একটি অসাধারণ শিল্পসম্মত ছবি।' প্রতিউত্তরে বাউলসম্রাট যে কথা বললেন তা শোনার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পরে তার কৌতুক বুঝতে পেরে না হেসে পারলাম না।
সেদিন প্রতিউত্তরে বাউলসম্রাট বলেছিলেন, 'ছবিতে আমার মাথা উপর দিকে কাটা। আর তুমি সেটাকে বলছ শিল্পসম্মত!' এ কথা বলেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। এ অপ্রস্তুত মুহূর্তে এগিয়ে এলেন বাউলতনয় শাহ নূরজালাল। নূরজালাল তার বাবার উদ্দেশে বললেন, 'বাবা, বইটা ভালা অইছেনি, সেইটা কও?' ছেলের প্রশ্নের জবাবে তিনি এবার বললেন, 'আমারে ভালা পাইয়া সুমন এ কাজটা করছে। তারে তো ধন্যবাদ সবার আগেই দিছি!'
এ তো গেল একান্তই নিজের কিছু স্মৃতিচারণ। তবে খুব কাছে থেকে দেখা বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের নির্লোভ চরিত্র ও সততা আমার মতো সবাইকে প্রচণ্ড মুগ্ধ করেছিল। পরিচিত-অপরিচিত যে কেউ তাকে গানের আসরে ডাকলেই চলে যেতেন। একের পর এক গান গেয়ে রাত পার করে দিতেন। ভরাট কণ্ঠ ও সুরমাধুর্য দিয়ে মুগ্ধ করতেন আসা শ্রোতাদের। এ গানের কারণেই মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সানি্নধ্য পেয়েছিলেন তিনি।
পরবর্তী জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতি ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছিলেন শাহ আবদুল করিম। সেটি বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যতেই কিছুটা টের পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে করিম ভাইও বেঁচে থাকবেন।' বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণেই বাউলসম্রাট ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে কবিয়াল রমেল শীলের সঙ্গে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণসঙ্গীত গেয়ে জনসভায় আসাদের বিমোহিত করেছিলেন।
এ সঙ্গীত সাধক ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার ধলাশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা ইব্রাহিম আলী ছিলেন গ্রাম্য কৃষক আর মা নাইওরজান বিবি গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় শাহ আবদুল করিম ছোটবেলা থেকেই বাউল গানের প্রেমে পড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন গানের জগতে। এরপরের সবটুকুই তো গানের ভুবন মাতানো ইতিহাস। গান গাওয়ার অপরাধে বাউলসম্রাটকে অনেকবার গ্রাম্য প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি ঈদের নামাজে কট্টর ধর্মান্ধদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিজের আবাসস্থল পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। গণমানুষের অপার ভালোবাসা তাকে আবার ফেরায় ধলাশ্রম থেকে উজানধল। ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে উজানধল গ্রামে বসবাস করে আসছিলেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। বাঙালি জাতির যে কোনো সংকট-সংগ্রামে বাউলসম্রাটের গান হয়ে উঠেছিল চেতনার হাতিয়ার।
বাউলসম্রাটের প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে 'আফতাব সঙ্গীত' (১৯৪৮), 'গণসঙ্গীত' (১৯৫৭), 'কালনীর ঢেউ' (১৯৮১), 'ধলমেলা' (১৯৯০), 'ভাটির চিঠি' (১৯৯৮), 'কালনীর কূলে' (২০০১) ও 'শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র' (২০০৯)। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার লোকসঙ্গীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে 'একুশে পদক' প্রদান করে। এছাড়া মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড (২০০৫), সিলেট সিটি করপোরেশন নাগরিক সংবর্ধনা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মাননাসহ (২০০৮) পেয়েছেন প্রায় আড়াই শতাধিক পদক, সম্মাননা ও সংবর্ধনা। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে তার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অবসান ঘটে।
বর্তমান সময়টা বড় টানাপড়েনের। কখনও কখনও সময়ই সংকটের সৃষ্টি করে। সংকটাপন্ন সময়ের কারণে হয়তো বাউলসম্রাটের গ্রামের বাড়িতে একটি জাদুঘর নির্মাণ আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়। একই অবস্থা শাহ আবদুল করিম সঙ্গীতালয়ের। এ দুটি কাজ আবার শুরু করা যায় সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও থাকতে পারে। এর পাশাপাশি দিরাই উপজেলা সদর থেকে উজানধল যাওয়ার মূল রাস্তাটি বাউলসম্রাটের নামে নামকরণ করা যেতে পারে। তার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকেই অন্তত এ কাজটুকু করা উচিত।
sumankumardash@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.