এ অসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি-সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ by আবু সাঈদ খান

দেশের মালিক জনগণ। সরকার জনগণের প্রতিনিধি। প্রতিনিধিদের কাজ হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিয়ত ধারণ করা এবং সেই মাফিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জনগণের বিবিধ সমাবেশ, গণমাধ্যম তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। সরকারকে তা অনুধাবন করতে হবে। তবে সরকার সওয়াল-জওয়াব করতে পারে,


যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিতে পারে। কিন্তু জনগণের কোনো অংশের প্রতি বিরূপ আচরণ করতে পারে না। বরং সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখাই হচ্ছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তব্য। সেটি না করে নির্যাতন বা অপকৌশল নিলে তা স্বেচ্ছাচারিতারই নামান্তর

রাজনীতিতে কোনো দল যদি কৌশল অবলম্বন করে তবে তাতে আপত্তির কিছু নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা যোগ্যতার পরিচায়ক বলে গণ্য হয়। তবে কৌশল যখন নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তখন সেটি অপকৌশল। অপকৌশল নিঃসন্দেহে অপরাজনীতিরই সমার্থক। এমন অপকৌশলের উদাহরণ দেখা গেল ২৯ জানুয়ারি বিএনপির গণমিছিলের কর্মসূচিকে সামনে রেখে সরকারের ভূমিকায়।
গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভা থেকে বিএনপি দেশব্যাপী গণমিছিলের ডাক দেয়। এটি নিঃসন্দেহে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি। তা যাতে নির্বিবাদে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের কর্তব্য। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, এর আগে অনুষ্ঠিত বিএনপি ও চারদলীয় জোটের রোডমার্চ কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেয়নি। বিএনপি সরকারের এ ভূমিকার প্রশংসা করেছিল। তাই ২৯ জানুয়ারির কর্মসূচিতে সরকারের সহনশীল ভূমিকা থাকবে_ এমন প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু কর্মসূচির দু'দিন আগে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখে একটি বয়ান শুনলাম যে, ঢাকার গণমিছিলে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বিএনপি কর্মসূচি অব্যাহত রাখল। পাশাপাশি বিএনপির গণমিছিলের দিনে আওয়ামী লীগও ঢাকায় জনসভার ঘোষণা দিল। অবশেষে ১৪৪ ধারা জারি করে রাজধানী ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে সভা-সমাবেশ বন্ধ করল পুলিশ। ১৪৪ ধারা জারির কারণ হিসেবে পুলিশের দুটি ভাষ্যই শোনা গেছে। জঙ্গি আশঙ্কা ও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা দুই-ই বলা হয়েছে। জঙ্গি হামলার কোনো আশঙ্কা থাকলে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া পুলিশের দায়িত্ব। সেটি না করে আতঙ্ক ছড়ানো হলো কেন? আমার জানতে ইচ্ছা হয়, হামলার আশঙ্কা কি কেবল বিএনপির মিছিল ঘিরেই, নাকি আওয়ামী লীগের সমাবেশও নিরাপত্তা সংকটে ছিল? জঙ্গিদের প্রস্তুতি জেনেও ক্ষমতাসীন দলের একই দিনে সভা ডাকার উদ্দেশ্য জঙ্গি হামলার ভাগ নেওয়া নয়, বরং বিএনপির কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করা_ তা ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, এমন পদক্ষেপ কি কেবল এ সরকার নিচ্ছে? না, তা নয়। অতীতের সব সরকারকেই এমন অপকৌশলের আশ্রয় নিতে দেখেছি। সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। সরকার ও বিরোধী দল উভয় দলের নেতানেত্রীদের কথাবার্তায় এর প্রমাণ পাই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও হালকা মন্তব্য করা হয়। সাম্প্রতিক সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ব্যর্থ ষড়যন্ত্র নিয়েও কাদা ছোড়াছুড়ি লক্ষ্য করছি। সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। তারা পরস্পর গুরুতর অভিযোগ আনছে। এমন অভিযোগ আনলে তা প্রমাণের দায়িত্ব পড়ে। কিন্তু বিষয়টি দৃশ্যত বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। জনগণও তাদের এ অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না। তা সত্ত্বেও তারা এই দোষারোপের রাজনীতি ত্যাগ করছে না।
ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা কথায় কথায় বিরোধীপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর অভিযোগ আনছে। সরকারের সমালোচনা ও আন্দোলন করা গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার প্রয়োগ করা মানে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর বিরোধিতা নয়। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে বলেই তাদের আর সব অন্যায় পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলা যাবে না_ তা কি হতে পারে?
রাজনীতির এই নীতিহীন কৌশল থেকে মুক্ত নয় বিএনপিও। মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বললেও বিএনপি কেবল ক্ষমতার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে দলটির অবস্থান স্পষ্ট নয়। একদিকে বলছে, তারাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে পথ চলছে। এটি গোঁজামিলের নীতিহীন রাজনীতি। ক্ষমতার জন্য চিহ্নিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টি নিয়ে সরকারের পথচলা যেমন সমর্থন করা যায় না, তেমনি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির আন্দোলনও মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি নীতিগত।
জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে সরকারের নীতিও স্ববিরোধী। আদালত '৭২-এর সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করায় ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, যারা ধর্মীয় বিধান চাপিয়ে দিতে চায়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার সমঅধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা যারা পোষণ করে না, তারা গণতান্ত্রিক হতে পারে না। আর তত্ত্বগতভাবে যে রাজনীতি অগণতান্ত্রিক, সেই রাজনীতির ধারকরা কোন বিবেচনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি করার অধিকার পাবে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গণতন্ত্রের শত্রুদের জন্য রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে গণতন্ত্রের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে না।
অথচ আদালতের রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। তবে যখন রাজনীতি করার লাইসেন্স দেওয়া হবে, তখন কেন মিছিল-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না; সেটি বোধগম্য নয়।
গণতন্ত্রের মর্মবাণী হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। কিন্তু সরকার দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। এর প্রকাশ কেবল ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতাদের প্রতিও কটাক্ষপূর্ণ কথাবার্তা অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েক দফা তাদের মিছিল-সমাবেশে হামলাও চালিয়েছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট বরেণ্য বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদেরও লাঞ্ছিত করেছে। গত ২৭ জানুয়ারি মাহী বি চৌধুরীর সামাজিক ওয়েবসাইটভিত্তিক সংগঠন ব্লু ব্যান্ড কলের (বিবিসি) পূর্বঘোষিত অনুষ্ঠান পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। সংগঠনটি রবীন্দ্র সরোবর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিল এবং নিরাপত্তার বিষয়টি পুলিশকেও জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও পুলিশ অনুষ্ঠানে চড়াও হয়ে ৮ জন সাংস্কৃতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে।
আলামত যা মিলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, টেলিভিশনের টক শো, ব্লগ-ফেসবুকের লেখালেখিও সরকারের অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমরা বেশ কিছু দিন ধরে নীতিনির্ধারকদের মুখে 'টক শো' নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুনছি। গত ২৭ জানুয়ারি আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এটিএন নিউজের 'সময়ের ভাবনা' টক শোটি। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্না জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন মহলের চাপে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালে নেতানেত্রীর ব্যঙ্গচিত্রের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পিলখানা ট্র্যাজেডির পর বন্ধ করা হয়েছিল ইউটিউব।
ফেসবুক, ইউটিউব, ব্লগ, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যম সংবাদপত্র-টেলিভিশনের মতোই জনমতের বাহন। জনগণ, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত তুলে ধরছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অজানা থাকার কথা নয় যে, ১/১১-এর পর বিরাজনীতিকরণ পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে এসব মাধ্যমে তরুণ সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে তারা সোচ্চার রয়েছে। দেশের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব তরুণ-তরুণীদের মনোভাব সম্পর্কে ধারণা নেওয়া এবং মূল্যায়ন করা। তা না করে এসব মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হবে বাক স্বাধীনতা হরণের শামিল।
দেশের মালিক জনগণ। সরকার জনগণের প্রতিনিধি। প্রতিনিধিদের কাজ হচ্ছে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিয়ত ধারণ করা এবং সেই মাফিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। জনগণের বিবিধ সমাবেশ, গণমাধ্যম তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। সরকারকে তা অনুধাবন করতে হবে। তবে সরকার সওয়াল-জওয়াব করতে পারে, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিতে পারে। কিন্তু জনগণের কোনো অংশের প্রতি বিরূপ আচরণ করতে পারে না। বরং সমালোচনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখাই হচ্ছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্তব্য। সেটি না করে নির্যাতন বা অপকৌশল নিলে তা স্বেচ্ছাচারিতারই নামান্তর।
এখন জিজ্ঞাসা যে, সরকারই কি কেবল গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে, আর বিরোধী দল যাচ্ছেতাই করবে? তা হয় না। বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে। বাস্তবে তারা তা কি করছে? বিরোধী দল জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েও লাগাতার সংসদ বর্জন করে চলেছে, সরকারকে ঘায়েল করতে অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
ক্ষমতায় থেকে বিরোধী শক্তিকে অরাজনৈতিকভাবে, অপকৌশলে মোকাবেলা করা যেমন অন্যায়, ঠিক তেমনি ক্ষমতার জন্য অরাজনৈতিকভাবে, অনৈতিকভাবে সরকারের কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করাও যৌক্তিক নয়। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমালোচনা ও সহযোগিতা উভয় নীতিই কার্যকর থাকতে হবে। উভয় দলকেই গণতন্ত্রের কষ্টিপাথরে পরখ করে দেখতে হবে কোনটি সঙ্গত, কোনটি অসঙ্গত।
কাদা ছোড়াছুড়ি করে আমরা অনেক সময় অপচয় করেছি, আর নয়। সংশ্লিষ্ট সবাইকে যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রকে আরও প্রশস্ত করতে হবে। কারও ভুলে গেলে চলবে না যে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্র যত প্রশস্ত হবে, ষড়যন্ত্রের পথ তত সংকুচিত হবে। তাই গণতন্ত্রকে নিরাপদ রাখতে অসহিষ্ণুতা আর অপরাজনীতির অবসান হোক_ সেটিই প্রত্যাশিত।
পুনশ্চ : আমি যখন এ লেখা শেষ করে এনেছি তখন খবর পেলাম বিরোধী দলের গণমিছিলে হামলা হয়েছে প্রায় সারাদেশে। চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। বিএনপি ঢাকার গণমিছিলের তারিখ পরিবর্তন করে ৩০ তারিখ নির্ধারণ করেছিল। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগও ৩০ জানুয়ারিতে সমাবেশ ডেকেছে রাজধানীতে।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.