‘দাদু’ প্রসঙ্গ by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

যে বাড়িতেই যান—ব্যথাহত প্রাণে দেখবেন, এই রকম একটি দাদাই সব কটি তরুণীকে নিয়ে আসর জাঁকিয়েছেন
স্টেশনের কাছে একটা রেস্তোরাঁয় বসে চা খাচ্ছিলুম। সামনে সাইকেল রিক্সার আনাগোনা, অদূরে দুটি আমের গাছে নতুন মুকুল। বসন্ত দেখা দিয়েছে, কিন্তু তার গায়ে এখনো শীতের হালকা চাদর জড়ানো।


আগেকার দিনে এই সময়ে লোকে কবিতার কথা ভাবত, আর আমি ভাবছিলুম অবিলম্বে টিকে নেওয়া উচিত। এমন সময়—
কী বললি? এই ছোঁড়া—কী বললি তুই?
গর্জন শুনে চেয়ে দেখলুম আমার সামনের টেবিলে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক একেবারে মারমূর্তি। আর পনেরো-ষোলো বছরের হাফপ্যান্ট পরা বয় থরহরি কম্পমান।
বয় একটু সামলে নিয়ে বললে: বলছিলুম ‘মামলেট’ দেব, না পোচ দেব? তাতে অন্যায়টা কি হয়েছে দাদু?
দাদু! ইয়ার্কির আর জায়গা পাসনি? কোন্ সুবাদে দাদু বলে ডাকিস্ আমাকে? ফের যদি ফাজলামো করবি তো একটি চড়ে আধখানা গাল উড়িয়ে দেব।
এর মধ্যেই হাঁ হাঁ করে মালিক ছুটে এলেন। করজোড়ে বলতে লাগলেন: আপনারা পুরোনো খদ্দের স্যার—এ নতুন এয়েচে, এসব ছেলে-ছোকরার কথায়—ইত্যাদি ইত্যাদি।
ব্যাপারটা আমার মনে তত্ত্বজিজ্ঞাসা জাগিয়ে দিল। শুধু এ জন্যে নয়—মনে পড়ে গেল, কিছুকাল আগে ট্রাম-বাস কন্ডাক্টারদের মুখে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ‘দাদু’ সম্ভাষণ বেআইনি করে দেওয়া হয়েছে। সেটা যে জনমতের চাপেই ঘটেছে তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে ‘দাদু’ প্রায় দদ্রু শব্দ থেকে নিষ্পন্ন—ওই রকম অশ্লীল এবং জ্বালাময়।
পশ্চিমে দেখেছি, অপরিচিত ব্যক্তিকে ‘মামা’ বলে ডাকলে মারামারির উপক্রম হয়ে থাকে। অর্থাৎ সম্বোধিত ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ বক্তার পিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটি অনুমান করে নেন। তাদের চটবার কারণ বুঝতে পারি। কিন্তু ‘দাদু’ শুনলে এতটা উত্তেজিত হবার কারণ কী?
বয়েস স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে থাকে। এবং যদিচ আমাদের প্রত্যেকেরই প্রবল আপত্তি আছে, তবু বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের সকলেরই বুড়ো হতে হয়। আমরা আয়না ধরে পাকাচুল তুলে থাকি, কেশের স্বাভাবিক সৌন্দর্য-বর্ধক তৈল (নিন্দুকে কলপ বলে) ব্যবহার করি, সখেদে জানাই—‘আমাদের বংশের ধারাই এই, বিশ পেরুতেই চুলে পাক ধরে!’ তবুও শেষ রক্ষা হয় না। ট্রামের লেডিস সিটের তরুণীটি যখন পাশের খালি জায়গাটি দেখিয়ে বলে, ‘বসুন না দাদু—বুড়োমানুষ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?’ তখন, সেই নিদারুণ মুহূর্তে একেবারে ‘স্বর্গ থেকে বিদায়!’ তারপর ‘মোহমুদগর’ আওড়ানো ছাড়া কিছুই আর করার থাকে না। তাই ‘দাদু’ সম্ভাষণে আমাদের এমন আপত্তি; তাই ডাকটা শোনবামাত্র আমাদের অন্তরাত্মা আর্তনাদ করে ওঠে।
সুনীতি চাটুজ্জ্যে মশাই কী বলবেন জানি না, কিন্তু আমার ধারণা কলকাতায় ট্রামে, বাসে হোটেলে রেস্তোরাঁয় যে ‘দাদু’ শব্দটির আমদানি হয়েছে—তার সঙ্গে বার্ধক্যের কোনো সম্বন্ধ নেই। আসলে ওটি কলার সংস্কৃতিতে পূর্ববঙ্গের অবদান। ‘সাথী’ শব্দের সাথী হয়েই ‘দাদু’র এতদ্দেশে অনুপ্রবেশ।
দাদা থেকে আদরার্থে ‘দাদু’—যেমন হাবা থেকে হাবু। পূর্ববঙ্গে দেখেছি সবেগে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বন্ধু বা প্রিয়জনকে অভ্যর্থনা জানানো হল: ‘কিরে দাদু, আছস কেমন?’ অনুরাগ একটু প্রবল হলে ‘দাদুয়া’ পর্যন্ত শেনা যায়। তাতে কেউ কখনো চটেন না এবং দাদুয়ার সঙ্গে দর্দুরের কোনো যোগসূত্রও কল্পনা করেন না।
অতএব ‘দাদা’ যদি মূল উৎস হয়—তাহলে ‘দাদু’ ডাকে আমাদের উত্তেজিত হওয়া উচিত নয়। বরং আর এটু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা প্রণিধান করা দরকার। দাদা হতে পারা কি খুব খারাপ? আর হওয়াটাই কি খুব সহজ?
অবশ্য পারিবারিক ‘দাদাত্বে’ তার মতো সুখের জিনিস সংসারে আর কি আছে?
তখন ভ্রাতাদের কাঁধে দোদুল্যমান পালকি আর সেই পালকিতে দাদার অধিষ্ঠান। রোদে পোড়া, জলে ভেজা, কাদায় আছাড় খাওয়া—এগুলো ভ্রাতাদের জন্যেই বরাদ্দ, দাদা দয়া করে তাদের কাঁধে চেপেছেন, এতেই তাদের ইহ-পরকাল ধন্য!
খরচের ভিতরে কিঞ্চিৎ বাণী-বিন্যাস কিন্তু আয়ের সম্ভাবনা অনন্ত। ক্ষীর-সর-গাড়ি-বাড়ি, ইলেকশনে সিদ্ধিলাভ এবং—আরো ঊর্ধ্বলোকের পথই বা ঠেকাচ্ছে কে! পনেরো বছর বয়সে একবার থানার দারোগাকে ভেংচি কেটে কিংবা বক দেখিয়ে ঘণ্টাখানেক হাজতে আটক থাকলেই হল, ‘দেশ-সেবা’ এবং ‘কারাবরণের’ সেই প্রিমিয়ামেই বাকি জীবনটা চমৎকার করে উৎরে যাবে—কেবল দাতা হতে জানা চাই।
সেন জানা অত সহজ নয়।
আরো এক রকম দাদা আছেন। তাদের ননী-ছানার ভাগ্য কেমন জানি না কিংবা কখনো কখনো রাজনৈতিক দাদার চাইতেও তাদের আমি বেশি ঈর্ষা করে থাকি। কবি বলেছেন: ‘রমণীর মন সহস্র বর্ষের সখা সাধনার ধন—এই সাধনায় তারা কেবল সিদ্ধই নন—একেবারে সিদ্ধাচার্য হয়ে বসে আছেন।
যে বাড়িতেই যান—ব্যথাহত প্রাণে দেখবেন, এই রকম একটি দাদাই সব কটি তরুণীকে নিয়ে আসর জাঁকিয়েছেন—সেখানে নাক গলাবেন, সাধ্য কি আপনার। তারাই মেয়েদের নিয়ে মার্কেটিঙে যান, নতুন গাড়ির ট্রায়াল দেন, ক্রিকেটের মাঠে সঙ্গিনীকে ‘লেটকাটে’র জায়গায় ‘লেকাট’ বোঝান, দুনিয়ার যত হাসির গল্প তাদেরই ঠোঁটাগ্রে! আপনি এক মাস চেষ্টা করেও যে মেয়েটির কাছে মুখ খুলতে পারেনি, তিন মিনিটেই তার সঙ্গে দাদা জমিয়ে নেবেন, পাঁচ মিনিট পরে দুজনে হাসিতে গড়িয়ে পড়বেন আর সেই অবিশ্বাস্য সিদ্ধিলাভ দেখে আপনার হূদয় শুধু হাঁড়ি-কাবারের মতো গুমে গুমে সিদ্ধ হতে থাকবে।
এদের যে কোনো একটি দাদা হতে আপনার আপত্তি আছে কি? আমার নেই। তাই ‘দাদু’ সম্ভাষণে আমি বিন্দুমাত্রও বিচলিত হই না—বরং একটা অদূর সম্ভাবনার আশায় আমার প্রাণ ময়ূরের মতোই নাচতে থাকে।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: লেখক। জন্ম ১৯১৮, মৃত্যু ১৯৭০।

No comments

Powered by Blogger.