প্রাথমিক পরীক্ষায় কৃতকার্যদের অভিনন্দনঃ যারা ফেল করেছে তাদের দিকে তাকান

সারাদেশে একযোগে প্রকাশ হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফল গত ২২ ডিসেম্বর। এটা ছিল দেশের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। ‘ছোটদের এসএসসি পরীক্ষা’ হিসেবে অভিহিত এ পরীক্ষার ফলাফলও হয়েছে আশাতীত। ফল প্রকাশকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক উত্সবের আবহ।
পাসের হার ৮৮ দশমিক ৯৪ ভাগ। পরীক্ষার এই ফলাফলের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, সারাদেশের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের সবাই রাজধানীর বাইরের স্কুলের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে দুটি মেয়ে, উপজেলা স্কুল থেকে। প্রথম হয়েছে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার মনোহরদী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী, দ্বিতীয় হয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আড়পাড়া শিবনগর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আর কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, পাসের হার বেশি ছাত্রীদের মধ্যে। সেরা দশের সাতজনই ছাত্রী—এটাও একটা আশাব্যঞ্জক সংবাদ। জানা গেছে, প্রকৃত পাসের হার ৮২ শতাংশ। ইংরেজি ও গণিতে কিছু নম্বর গ্রেস দিয়ে হার বাড়ানো হয়েছে। শিশুদের এই বিপুল সাফল্য দেখে তাদের এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আমরাও আনন্দিত ও আশান্বিত। সবাইকে আমাদের শুভেচ্ছা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এই পরীক্ষায় অংশ নিতে নিবন্ধন করেছিল সারাদেশের পঞ্চম শ্রেণীর মোট ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯৫ ছাত্রছাত্রী। পরীক্ষা দিয়েছে ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন। পাস করেছে ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৭ লাখ ৫১ হাজার ৪৬৫ ও ছাত্রী ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৮৯। শতকরা হিসাবে প্রথম বিভাগ পেয়েছে ৪১ দশমিক ৭৭ ভাগ। দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছে ৩৭ দশমিক ৯৮ ভাগ এবং ২০ দশমিক ২৫ ভাগ পেয়েছে তৃতীয় বিভাগ। এ থেকে আঁচ করা যায়, মেধার দিক থেকে আমাদের শিশুরা নিঃসন্দেহে আশাতীত সংখ্যায় ভালো করেছে। বিশেষত কথিত পিছিয়ে পড়া মেয়েরা পড়াশোনার প্রাথমিক স্তরেই তাদের মনোযোগ ও মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, প্রথম বিভাগ প্রাপ্তির সংখ্যা এবং শতভাগ পাসের হারের দিক দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে রাজধানী ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। দ্বিতীয় ঢাকার মণিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, তৃতীয় মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সব মিলিয়ে এ পরীক্ষা থেকে রাজধানীসহ অন্যান্য শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান সম্পর্কেও একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া বিদ্যালয়গুলোকে যেমন শনাক্ত করা যাবে, তেমনি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার গতি-প্রকৃতি বিবেচনা করে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা নেয়াও হবে সহজতর।
সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হবে। তাছাড়া এবারও মেধার ভিত্তিতে ২০ হাজার শিক্ষার্থীকে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি এবং ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেয়া হবে জেনারেল গ্রেডে। উদ্যোগটি ভালো। তবে পাশাপাশি সরকার তথা সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে, দেশের ১৯৩৭টি স্কুলের কেউ পাস করেনি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৫৯টি। রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৯০টি, কমিউনিটি বিদ্যালয় ১২০টি, এনজিও পরিচালিত ৩৩টি, আনন্দ স্কুল ১ হাজার ৩৬টি, শিশু কল্যাণ বিদ্যালয় ৮টি ও অন্যান্য ২৯১টি। এই সংবাদ স্বভাবতই হরিষে বিষাদের জন্ম দিয়েছে। অন্যরা যেমন তেমন, সরকারি স্কুলের এহেন ব্যর্থতা যে কাউকে ভাবিয়ে তোলে। এসব প্রতিষ্ঠানের ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এখনই চিন্তা-ভাবনা না করলে তার পরিণাম ভালো না হওয়ারই কথা। এমনিতেই প্রাথমিক স্তরে এদেশে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার সংখ্যা রীতিমত ভীতিকর। তার ওপর যদি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে, তাহলে তা সবার জন্যই হবে দুঃখজনক। এ অবস্থায় সবারই প্রত্যাশা, কৃতকার্যদের জন্য যেমন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সব অন্তরায় দূর করতে হবে, তেমনি ফেল করা শিক্ষার্থীদেরও ধরে রাখতে হবে পড়াশোনায়। তার আগে খতিয়ে দেখতে হবে অকৃতকার্যতার কারণ। এ দায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, অভিভাবক, পরিচালক সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর তথা সরকারের।

No comments

Powered by Blogger.