রেলকম ঝমাঝম by অমিত বসু

মহাকাশযানের জার্নিটা কেমন জানি না। না চড়লে জানব কী করে। চড়েছি গরুর গাড়ি, রিকশা, অটোরিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেল, বাস, মোটরকার, নৌকা, জাহাজ, হেলিকপ্টার, প্লেনে। সবার ওপরে ট্রেন। টেনে টেনে। চঞ্চল। ছোটে মাত্রা ছাড়া। রোমাঞ্চ। কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এঙ্প্রেসে খুশি আরো বেশি। প্রথম দিকে গতি কমত গেদে-দর্শনার কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের ঝঞ্ঝাটে। পাক্কা চার ঘণ্টা নষ্ট। এখন কমে আড়াই থেকে তিন। কাজটা কামরাতেই সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা। আগে রিটার্ন টিকিট পাওয়া যেত না।

এবার পাওয়া যাবে। তবে টিকিট পাওয়া কঠিন হবে। দুই মাস পিছিয়ে দেখলে ছবিটা ছিল অন্য রকম। মৈত্রী এঙ্প্রেসের নাম হয়েছিল দুর্গতি এঙ্প্রেস। যাত্রীহীন ট্রেনের ব্যথাতুর যাত্রা। কামরায় কামরায় মরুভূমির শূন্যতা। দিনদুপুরেও রেলকম ঝমাঝম নয়, ভয়ে গা ছমছম। কী হয়, কী হয়, ভয়। তত্ত্বাবধানে থাকা ভারত-বাংলাদেশের রেল কর্মচারীরা উৎকণ্ঠায় তটস্থ। এবার ট্রেনে উঠতেই তাঁদের হাসিমুখ। একবাক্যে অভয় দাস, চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। জিজ্ঞেস করলাম, যাত্রীরা কত না নিন্দেমন্দ করেছেন। আপনাদের কোনো অভিযোগ নেই? নির্মল জবাব, প্রথম থেকেই আছি। ডিউটি চার্ট অপরিবর্তিত। অসংগতির সঙ্গে লড়ে জিতেছি। এটা একটা বড় যুদ্ধজয়। জেতার পুরস্কার কিন্তু পাইনি। চাইওনি। একটু পিঠ চাপড়ানি পেলে ভালো লাগত। প্লিজ, আমাদের কারো নাম লিখবেন না। কমপ্লিমেন্ট ভিক্ষা করতে লজ্জা লাগে।
পাবনা-ঈশ্বরদী পেরোতেই একজন কেবিনের দরজা ফাঁক করে বললেন, অভ্যাস না থাকলেও এবার একটু মাথা হেঁট করতে হবে। সামনে যমুনা। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ট্রেন যাবে। চোখ ভরে দেখবেন আমাদের মেয়েটাকে। মাথা নিচু করে দেখলাম সেই রূপসীকে। কোথায় সে রূপ। চেহারার কী ছিরি। অরক্ষণীয়ার মতো অনাহারে, অনাদরে দীর্ঘ। তার আগে পদ্মাকেও দেখেছি কী রোগা, দুর্বল। নদীমাতৃক দেশ। মা গেলে থাকল কী। মা ভাগাভাগিতে নিত্য বচসা। মরমে মরছে মা। ফইছে শরীরে। মেয়েও তো মা। কষ্টে চোখ ফেরাতে হয়। পাশের যাত্রী বললেন, বর্ষায় নদীরা একটু ভালো থাকে। তারপর যে কে সেই। কবি বিনয় মজুমদারের লাইন মনে পড়ল, 'কোথায় স্নান করব, সব নদী বিক্রি হয়ে গেছে।' যে নদীতে গোড়ালি ডোবে না, যার মেদ কুরে খেয়েছে বেলাজ খিদে, তাতে ডুব দেওয়ার অবকাশ কোথায়?
গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রণা। ই-মেইল চালাচালিতে সব প্রকল্প বিলম্বিত। ভারত বাংলাদেশকে যে ১০০ কোটি ডলার সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছে, তার এক ডলারও ঘরে তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। হাত শূন্য। নিয়মের ফাঁকে হাঁসফাঁস করছে। ব্যবস্থাটা শিথিল হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত। রেলের পালে হাওয়া লাগত।
ঘরের রেল সামলাতে সসেমিরে অবস্থা। সামনে আন্তর্জাতিক টার্গেট। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের কাজ প্রাথমিক অবস্থায় আটকে আছে। এটা হলে ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ রেললাইনে বাঁধা পড়বে। আপাতত ভারতের ঋণে খুলনা থেকে মংলা পোর্ট পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন বসানোর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। মংলা পোর্ট ব্যবহারের সুযোগ পেলে ভারতের আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন সহজ হবে। রহনপুর-সিংহাবাদ ব্রডগেজ লাইন নেপালের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই কারণে রাধিকাপুর-বিরল মিটার গেজকে ব্রডগেজে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রান্স এশিয়ান চালু করতে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কঙ্বাজার এবং রামু-গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ হবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের টাকায়। তারা দেবে ১৫ কোটি ডলার। কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন বন্ধ। সেটা চালু করার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভারতের অনুদানে হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন। এটা বাংলাদেশের মধ্যে পড়ছে না। লাইন বসছে ভারতের ভূখণ্ডে। বাংলাদেশ এটাকে তাদের পাওয়া বলে মনে করছে না। তাদের রেলের সমস্যা অনেক। ৪৪০টি স্টেশনের মধ্যে ১৬০টি বন্ধ। জরুরি ভিত্তিতে সেগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ বাড়াতে কমিউটার ট্রেন চালু হবে। চীন থেকে আনা হচ্ছে ২০ সেট কমিউটার ট্রেন। জাপান-কোরিয়া সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কম্পানি ১১টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ তৈরি করে পাঠাচ্ছে। তাতে যুক্ত জাপান। দেবে ৪৩৯ কোটি বাংলাদেশি টাকা। বাংলাদেশ রেলওয়ের আলাদা অস্তিত্ব ছিল না এত দিন। যোগাযোগ মন্ত্রকের কাছে কাকের ঘরে কোকিলছানার মতো পালিত হচ্ছিল। এবার স্বাধীনভাবে উড়তে শিখেছে। রেল ভবনে রেলমন্ত্রক দাপিয়ে কাজ করছে। সংসদে আলাদা রেল বাজেট পেশ হবে। রেল বোর্ড গঠনের কাজও এগোচ্ছে। রেল যুদ্ধে সেনাপতি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর লেফটেন্যান্ট মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবু তাহের রেলের পুনর্বিন্যাসে শশব্যস্ত। ভারত যদি সদয় হতো, কাজটা আরো সহজ হতে পারত। বাংলাদেশ রেল মন্ত্রণালয় যতই তৎপর হোক, তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে মৌলবাদীরা। দেশের শরীরে শিরা-উপশিরার মতো রেলপথ ছড়িয়ে পড়ুক, তারা চায় না। তাদের সন্তুষ্টি বিচ্ছেদ ব্যবধানে। ভারত-বাংলাদেশ কাছাকাছি হওয়াটা চক্ষুশূল। ভারত বিদ্বেষের চারা পোঁতার কাজ চালাচ্ছে সর্বত্র। তিস্তা চুক্তি স্থগিত হওয়ায় হা-হা হাসির হুল্লোড়। মনে মনে কুর্নিশ জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই সঙ্গে ছক কষছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উৎখাতের। তাদের বক্তব্য, হাসিনা সরকার ধ্বংসাত্মক।
লেখক : সাংবাদিক, কলকাতা

No comments

Powered by Blogger.