নারী অধিকার এবং মর্যাদা— প্রচলিত ‘মিথ’ ও বাস্তবতা by ড. এ. কে. এম. আজহারুল ইসলাম

আল্লাহপ্রদত্ত বিধিবদ্ধ কোরআনের আইন পরিবর্তন করে পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে নারীর সুষম অধিকার পরিবর্তনের প্রস্তাব বিগত জরুরি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন করেছে বলে বেশ কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি এসেছিল। বায়তুশ শরফের পীর আল্লামা শাহ মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ নামে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের যে আইন (নীতিমালা) সরকার অনুমোদন করেছে তা কোরআন ও সুন্নাহর বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সরকারের তরফ থেকে পরবর্তী সময়ে এটি স্থগিত হওয়ার সংবাদ প্রচারিত ও কমিটি গঠন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও ব্যাপারটি সুরাহা হয়েছে বলে মনে হয় না।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গত বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) বেগম রোকেয়া পদক দান অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে নারীদের সমঅধিকার দেয়ার লক্ষ্যে উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের যে ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উলামা মাশায়েখ কমিটির প্রখ্যাত আলেমরা। এক বিবৃতিতে তারা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি ক্ষমতায় গেলে ‘কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করবেন না’ মর্মে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ তিনি উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা সুস্পষ্টভাবে কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী। তার সরকার ১৯৯৭ সালে যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি করেছিল তাতে উত্তরাধিকার আইনের ওপর হস্তক্ষেপ করেনি। এবার তিনি ক্ষমতায় এসে যাদের প্ররোচনায় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করতে চাচ্ছেন তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন গণবিরোধী লোকদের পক্ষেই এ ধরনের উদ্ভট চিন্তা করা সম্ভব। জনগণের প্রতিনিধিদের পক্ষে এ ধরনের ইসলাম বিরোধী চিন্তা করা সম্ভব নয়। তারা বলেন, বর্তমানে যারা প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরাধিকারী আইন সংশোধন করার জন্য কুপরামর্শ দিচ্ছেন তারাই বিগত জরুরি সরকারকে দিয়ে এ কাজটি করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামী জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে আবার তারা এ সরকারকে দিয়ে সেই ইসলামবিরোধী কাজটি করাতে তত্পর হয়েছেন। আমরা সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই, উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের মতো ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে হাত দেবেন না। দেশের ইসলামী জনতা কখনও কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন মেনে নেবে না (আমার দেশ, ১২ ডিসেম্বর ২০০৯)।
কোরআনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কম জানেন বা একেবারেই জানেন না তারা হয়তো বলবেন, নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পদ বিতরণে কোনো বৈষম্য থাকবে না—এটিই তো ভালো। তাহলে এসব প্রতিবাদ কেন? ‘প্রগতিবাদী’ বলে দাবিদার যারা, তারা হয়তো বলবেন, এজন্যই তো রাষ্ট্র বা সমাজ জীবন থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করতে হবে, নইলে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমবে না। অস্পষ্টতা বা অজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট এই বিতর্কের পটভূমি ও নারী অধিকার সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু আলোচনা করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে।
বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার ও নারী অগ্রাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয়। নারীদের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এবং নারীদের অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠাকল্পে বিভিন্ন ‘নারী অধিকার’ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। ১৩ জুলাই ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নারী অধিকার আন্দোলনের সূচনা হয় এবং দীর্ঘ ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রায় সাত প্রজন্ম পর তারা নারী অধিকার অর্জনে কিছু সাফল্য পেয়েছে। সমঅধিকার আইনের সংশোধনী (The Equal Rights Amendment)-এর খসড়া প্রস্তাবিত হয় ১৯২৩ সালে এবং সংশোধনীটি মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন পায় ১৯৭১ সালে যা পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অঙ্গরাজ্যের (ন্যূনতম ৩৮) সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ১৯৮২ সালে রহিত হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের শাস্তি আইন সংশোধন করা হয়। ১৫০ বছরের পারিবারিক জীবনে, ধর্ম চর্চায়, সরকারে, পেশাগত জীবনে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের অনুকূলে এই পরিবর্তন আসে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ৭ম শতাব্দীর শুরুতে আবির্ভূত ইসলাম ধর্মের দর্শন বহুমাত্রিক সমতাবাদী। স্ত্রীদের প্রতি সমান ও অভিন্ন আচরণ, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং এতদসংক্রান্ত অনেক আয়াত পবিত্র কোরআনে পাওয়া যায়। এর সবগুলোই জেন্ডার-সাম্যের পক্ষে বড় দলিল। ‘আজ এ কথা মনে করা হয়ে থাকে যে, ইসলামী মূল্যবোধে সাম্যের কোনো কথা নেই বরং পশ্চিমা বিশ্ব এই লিঙ্গ-সাম্য নিশ্চিত করেছে। তদুপরি ইসলামী কাঠামোয় নারীদের সমান অধিকার পাওয়া কঠিন এবং নারীদের এই প্রচেষ্টা নিরর্থক।’ শুধু পশ্চিমাদেরই নয় আমাদের দেশের অনেকের এসব ভ্রান্ত ধারণা মোচনের জন্য ইসলামের বাণী ও শিক্ষাসমূহ সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা একান্ত আবশ্যক।
নারী উন্নয়ন নীতির নেপথ্যে : ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত নারী নীতি ঈঊউঅড নামে পরিচিত (পরবর্তী সময়ে ১৯৮০, ১৯৮৫, ২০০০ সালে একই বিষয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত)। বাংলাদেশে নারী উন্নয়ননীতি-২০০৮-এর আড়ালে মূলত CEDAW ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে বর্তমান প্রচেষ্টা (দ্রষ্টব্য : ধারা ৩:২, ৩.৩, ৩.৫, ৩.৬ নারী উন্নয়ননীতি-২০০৮)। স্মর্তব্য যে, এর আগের সরকারগুলো কোরআনী আইন বাতিল করতে হবে বলেই ঈঊউঅড-তে শর্তসাপেক্ষে স্বাক্ষর করেছিল। নীতিমালায় বেশকিছু বিষয় আছে যা নারী উন্নয়নের সহায়ক, আবার কিছু বিষয় আছে যা কোরআনী বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি কোনো প্রচলিত বা প্রতিষ্ঠিত আইন, বিধান-নিয়মনীতি, লোকাচার বা প্রথা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সে সবকে বাতিল বা সংশোধন করতে হবে। অর্থাত্ বাংলাদেশে প্রচলিত উত্তরাধিকার আইন, বিয়ে-শাদি, তালাক ইত্যাদি বিষয়ে সংশোধনী আনতে হবে। স্মরণযোগ্য যে, জাতিসংঘ (দ্রষ্টব্য : ১৯৯৫ মিসর যুব উন্নয়ন সম্মেলন) মানুষের স্বাধীনতার স্বীকৃতিস্বরূপ মাতৃত্বের স্বাধীনতা, নারীতে নারীতে ও পুরুষে পুরুষে বিয়েকে যে বৈধতা দিয়েছে তার বাধাস্বরূপ প্রচলিত আইন ও প্রথাকে বাতিল করার নীতি ঘোষণা করেছে। এসব দ্বারা মূলত ধর্মীয় নীতিকেই বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। কোনো মুসলমান ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কুরআনী আইনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে না বলেই কৌশলে তাদের মাঝে জাতিসংঘ-ঘোষিত ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চায়। কাজেই এসব কথা মনে রেখেই আমদের নারী উন্নয়ননীতি করতে হবে।
নারী অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশসহ পাশ্চাত্যে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপিত ও আলোচিত হচ্ছে। মুসলিম নারীদের সব সময় সবচেয়ে বঞ্চিত ও নির্যাতিত গোষ্ঠী মনে করা হয়। পশ্চিমে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, মুসলিম নারীদের পতিরা তাদের সঠিক বা ন্যায্য মর্যাদা দেয় না এবং সব সময় তাদের উপর অন্যায় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। দেশে ও পশ্চিমে প্রচার মাধ্যমগুলো এই অপবিশ্বাসকে আরও উস্কে দিচ্ছে এবং অসত্যভাবে রাঙিয়ে প্রচার করছে। তাদের এই বক্তব্য কতটুকু সত্য? মুসলিম নারীরা সমাজে কী মর্যাদা নিয়ে থাকবে এবং ইসলাম তাদের কী কী অধিকার নিশ্চিত করেছে আমরা এখন এ বিষয়টি আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
নারীর মর্যাদা :
আগেই বলা হয়েছে ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সারা বিশ্বে নারীদের করুণ অবস্থাই বিরাজমান ছিল এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে নারীরা যুক্তরাষ্ট্রে কিছু মৌলিক অধিকার পেতে শুরু করে। কিন্তু ৭ম শতাব্দীর শুরুতে ইসলামের আগমনের শুরু থেকেই নারী-পুরুষের সমান অধিকারসহ আরব ভূ-খণ্ডে নারীদের অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ইসলামের শিক্ষায় ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ জীবনের সব দিক ও বিভাগে নারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তদুপরি মহানবী মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর আদেশ পালন করে নারীদের প্রতি সৌজন্যপূর্ণ, শ্রদ্ধা ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছেন। আদর্শ মুসলিম পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্য কোরআনে নির্দেশনা রয়েছে। গত ১৪শ’ বছর ধরে মুসলিম নারীরা যে অধিকার অর্জন ও ভোগ করে আসছেন পশ্চিমা নারীরা তার অংশ বিশেষ অধিকার অর্জনে এখনও সংগ্রাম করে চলেছেন।
নারী নিগ্রহ কোরআন বিরোধী কাজ : মুসলিম বিশ্বে নারীরা নিগৃহীত মর্মে একটি অপপ্রচার পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষ গোঁড়া নারীবাদীরা মনে করে ‘কোরআনে নারীদের পুরুষের অধীন করা হয়েছে।’ জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম-খ্রিস্টান অধ্যয়ন কেন্দ্রের সহযোগী পরিচালক এবং ইসলামের ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক জন ভল স্বীকার করেছেন যে, মূল ধারার নারীবাদীদের অধিকাংশই কোরআন বর্ণিত Gender equity-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরও বলেন, সাধারণ রক্ষণশীল মুসলমানসহ মূল ধারার মুসলমানরা মনে করেন নারী ও পুরুষের প্রাকৃতিক ও জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্য সত্ত্বেও কোরআন Gender equity-র মহান শিক্ষা নির্দেশ করে।
আল্লাহ নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কোরআনের অনেক জায়গায় আল্লাহ এই ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন ‘তিনি তোমাদের একটি মাত্র দেহ (আদম) থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর ঐ দেহ থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন’ (কোরআন ৩৯ : ৭)। সুতরাং নারীর তুলনায় পুরুষরা শ্রেষ্ঠ (superior) এটি কোরআনের শিক্ষা নয় এবং এ ধারণাও সঠিক নয়। অবশ্য কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে নারীর মর্যাদা খাটো করা হয়েছে।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী’ বিভাগের শিক্ষক Dr. Hibba Abugideiri বলেন, ‘মুসলিম নারীরা একটি সমজাতীয় গোষ্ঠী নয় এবং তারা কোনোভাবেই অমুসলিম নারীদের তুলনায় অধিক নিগৃহীত এবং নির্যাতিত নয়। মর্যাদা, সম্পদের অধিকার... এমনকি আইনি অধিকার অর্জনে পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা পৃথিবীতে রমণীরা তুলনামূলকভাবে কম সুবিধাপ্রাপ্ত।’ কোরআন মুসলমান নারীদের পরাধীন করেছে কিনা মর্মে প্রশ্নের জবাবে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘না, কোরআন মুসলিম নারীদের অবদমন করেনি। যদি তাই হতো তবে কেন এত বিপুলসংখ্যক মুসলিম নারী, যাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, এই নারী বিদ্বেষী ধর্ম চর্চা করবেন? এটা নিছক অযৌক্তিক মতামত এবং মুসলিম ধর্ম বিশ্বাসীদের অর্ধেক ১২০ কোটি জনসংখ্যার বুদ্ধিবৃত্তিকে খাটো-বিবেচনা করার নামান্তর।’ মুসলিম বিশ্বে প্রচারিত কিছু গল্পের আলোকে গণমাধ্যমসমূহ মুসলিম নারীদের নিগৃহীত হিসেবে চিত্রিত করা শুরু করে।
মূর্খতা আশ্রিত স্থানীয় কিছু প্রথা ও সংস্কার অজ্ঞ লোকদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। ফলে মুসলিম সমাজে এখনও অন্য সংস্কৃতি থেকে উদ্ভুত পারিবারিক প্রথা বিশেষ করে যৌতুক প্রথা বিরাজমান। নিউ ইয়র্কের ইথাকা কলেজের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি, বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত, ড. আসমা বারলাস কংগ্রেস লাইব্রেরিতে প্রদত্ত এক ভাষণে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘মুসলিম সমাজে প্রচলিত বহু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এবং কোরআনের শিক্ষার সঙ্গে এর কোনো সাযুজ্য নেই।’
অর্থনৈতিক অবস্থা :
ইসলাম নারীকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করেছে। ব্যক্তিগত অর্জন এবং উত্তরাধিকার, উভয় পর্যায়েই নারী সম্পদের মালিক হতে পারবে। তাছাড়া এই সম্পদের উপর তার পূর্ণ এখতিয়ার থাকবে এবং এর ব্যবস্থাপনার পূর্ণ অধিকার তিনি সংরক্ষণ করবেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সম্পদের সুষম ব্যবস্থাপনা ইসলামের শিক্ষা। পবিত্র কোরআন এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে, ‘আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না এমন সব বিষয় যাতে আল্লাহতায়ালা তোমাদের একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর।’ (কোরআন ৪:৩২) একজন বিবাহিত মুসলিম মহিলা তার ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। কারণ, তার অর্থের যোগান দেয়া স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রীর অধিকার ও প্রয়োজন মেটানো স্বামীর দায়িত্বের অন্তর্গত। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ও পারিবারিক প্রয়োজনের অর্থ স্বামী যোগান দেবেন। কোরআনের নিম্নোক্ত ঘোষণায় এই বিধান উল্লিখিত হয়েছে। ‘পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যের (স্ত্রীর উপর স্বামীর) শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এজন্য যে, তারা (স্বামীরা) তাদের অর্থ ব্যয় করে (স্ত্রীর ভরণ-পোষণের জন্য) ... (কোরআন ৪: ৩৪)।
মোহরানা : বিয়ের সময় একজন মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে মোহরানা প্রদান করে। এর মাধ্যমে মুসলিম নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা আরও শক্তিশালী ও সংরক্ষিত করা হয়েছে। এই মোহরানা একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এতে স্বামীর কোনো অধিকার নেই, যদি না সে স্বেচ্ছায় স্বামীকে কোনো অংশ না দেয়। কোরআন বিশেষভাবে বলেছে, ‘এবং স্ত্রীদের খুশি মনে তাদের মোহরানা দিয়ে দাও। তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর’ (কোরআন ৪: ৪)। কিছু মুসলিম দেশে বিশেষ করে গরিব লোকজনের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী কাজ পরিলক্ষিত হয়। প্রায়ই দেখা যায় যে, বরপক্ষ কনের পরিবারের কাছ থেকে টাকা-পয়সা এবং গৃহসামগ্রী দাবি করে। এই অনুশীলন একান্তই ইসলামের শিক্ষা বিরোধী।
উত্তরাধিকার (মীরাস) : ইসলাম নারীকে সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার অধিকার দিয়েছে। দাদী, মা, স্ত্রী, কন্যা এবং বোন হিসেবে নারী পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার পাবে। কোরআনের আদেশ নিম্নরূপ: ‘পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে, অল্প হোক কিংবা বেশি এ অংশ নির্ধারিত’ (কোরআন ৪:৭)।
১৪শ’ বছর আগে অবতীর্ণ কোরআনের এই নির্দেশনা নারীর মর্যাদা অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি করেছে। এর আগে এবং পশ্চিমে মাত্র কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত নারীরা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে কোনো উত্তরাধিকার পেত না। কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. শেরিফ আবদেল আজিম ইসলামে নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত প্রচলিত ‘মিথ’ ও বাস্তবতা এবং ইহুদি-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের এক তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করেছেন। পশ্চিমের সমাজে বিষয়টি কোনো ব্যক্তির উইল দ্বারা নির্ধারিত যা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, আইনজীবী কিংবা আদালত ব্যাখ্যা করে থাকে।
ইসলাম সবিস্তারে উত্তরাধিকার আইন ব্যাখ্যা করেছে। কোরআনে এই আইনের নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এবং হাদিসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আরও জানার জন্য যে কেউ নির্ভরযোগ্য ইসলামী তথ্যভাণ্ডার দেখে নিতে পারেন।
আত্মীয়দের সংখ্যা এবং উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পর্কের বিবেচনায় সম্পত্তি বিভাজন সংক্রান্ত নিয়মাবলী সুরা আন নিসায় (৪:১১-১২) অবতীর্ণ হয়েছে। নিজ সন্তানদের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান ঃ ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমাদের ছেলে দুই মেয়ের সমপরিমাণ অংশ পাবে আর যদি মেয়ের সংখ্যা হয় দুই বা ততোধিক হয় তাহলে তারা দুই তৃতীয়াংশ পাবে, আর যদি মেয়ের সংখ্যা এক হয় (ভাই না থাকে) তাহলে সে অর্ধাংশ পাবে।’ মৃতের পিতা-মাতার জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির ছয় ভাগের একভাগ (প্রত্যেকের জন্য), যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে তবে মৃতের সম্পদে পিতা-মাতার অংশ সমান

No comments

Powered by Blogger.