বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার চার্জ দাখিল শিগগির by ওয়াকিল আহমেদ হিরন

বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার তদন্ত কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এ মামলার তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনালের এক তদন্ত কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে দেশে ফিরেছেন। সূত্র জানিয়েছে, শিগগির চার্জ প্রস্তুত করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।


২০০২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছিল। সে সময় জানানো হয়েছিল, জীবিত থাকা ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে মামলা করা হবে। যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জিয়াদ আল-মালুম সমকালকে বলেন, ঢাকার রায়েরবাজারসহ সারাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের তদন্ত কাজ অব্যাহত আছে। দুই আসামি আশরাফুজ্জামান ও মাঈনুদ্দিনের বিষয়ে তদন্ত
কাজ চলছে। শিগগির একটি সংবাদ দেওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলেও প্রথমে আলাদাভাবে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। পরে পৃথকভাবে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তদন্ত সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করছেন।
১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা করা হয়। ওই মামলায় আলবদর বাহিনীর সদস্য চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু। অভিযুক্ত চৌধুরী মাঈনুদ্দিন লন্ডন ও আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্ক প্রবাসী।
মামলাটি পরে সিআইডিতে পাঠানো হয়। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমানকে (বর্তমানে অবসরে)। তিনি মামলার তদন্ত পর্যায়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা দায়েরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চান। তদন্ত চলাকালে তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনসহ ৪০ জনের সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে মামলাটি নতুন করে দায়েরের জন্য সিআইডিকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সিআইডি সূত্র জানায়, রমনা থানার মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানো হয়। এরপর গত আট বছর আর কোনো অগ্রগতি নেই। গত বছর মামলার যাবতীয় নথিপত্র ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে হানাদারদের এদেশীয় দোসর আলবদর বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
মামলার বর্ণনা : বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মুহসীন হল সংলগ্ন বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। হলের সামনে তাকে পেয়ে দারোয়ান আবদুর রহিমের গামছা নিয়ে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির একটি মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। ঘাতকরা অন্যান্য হাউস টিউটরের বাসায়ও যায়। এ সময় ওই হলের ছাত্র ছিলেন বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। তিনি পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পরে তারা জানতে পারেন, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ড. মোঃ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেককে ধরে নিয়ে গেছে আলবদররা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মোঃ মুর্তজার স্ত্রী ও সিরাজুল হকের ছেলে এনামুল হক অপহরণকারীদের দু'জনকে চিনতে পারেন। তারা হলেন চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান। দু'জনই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান তৎকালীন অবজারভারে সাংবাদিকতা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরিদা বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে আজিমপুরের ভাড়া বাসায় চলে যান। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তিনি তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ দেখতে পান। ৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছ থেকে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.