মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড-ক্ষোভ থেকেই মোবারকের মদদে খুন করে শরীফ-নেপথ্যে রাজনীতিসহ একাধিক কারণ by সুমন বর্মণ

রসিংদী পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেনের মূল হত্যাকারী নাজমুল হাসান শরীফ ওরফে কিলার শরীফ দাবি করেছে, ভাড়া নয়, ক্ষোভ থেকেই মোবারক হোসেন মোবার সহায়তায় মেয়র লোকমান হোসেনকে খুন করে সে। মোবারক অন্য কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। তবে সে মেয়র লোকমানকে হত্যা করতে মোবারকের কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি বলে দাবি করেছে।


পাশাপাশি শরীফ পুলিশকে বলেছে, লোকমানের মৃত্যু হলেও তাঁর আত্মার মৃত্যু হয়নি। তাঁর শরীর কবরে থাকলেও আত্মা রয়েছে
তার কাছে। আল্লাহ লোকমানের মৃত্যু তার হাতে লিখেছিল। তাই তার হাতেই লোকমানের মৃত্যু হয়েছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
পুলিশ বলছে, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক কারণসহ একাধিক কারণ রয়েছে।
অন্যদিকে খুনি শরীফের দাবির সঙ্গে একমত নয় নিহত লোকমানের পরিবার। তারা দাবি করেছে, শরীফ হত্যাকারী, তবে মোবারক তাকে ব্যবহার করেছে। মোবারকসহ মামলার অন্য আসামিরা এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছে। পরিকল্পনাকারীদের বাঁচানোর কোনো ষড়যন্ত্র হলে নরসিংদীবাসী তা মেনে নেবে না।
গতকাল মঙ্গলবার মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হত্যা ও অস্ত্র মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে ১৪ দিন এবং অস্ত্র মামলায় আরো একজনকে এক দিনের হেফাজত (রিমান্ড) মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এদিকে নরসিংদী পৌর মেয়রের শূন্য পদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ১৯ জানুয়ারি নির্বাচন হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ দাবি করেছে, বছর দুয়েক আগে নরসিংদীর বীরপুরে রনি ওরফে ইঞ্জিন রনি হত্যা মামলায় যখন তাকে আসামি করা হয়, তখন সে রনির মা-বাবার কাছে যায়। রনির পরিবার জানায়, তারা তাকে আসামি করেনি, মেয়র করিয়েছে। সে মেয়রের কাছে গিয়ে সহযোগিতা চায় এবং মেয়রও তাকে বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেয়। পরবর্তী সময়ে মেয়র তাকে ডেকে এনে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন।
শরীফ পুলিশকে বলেছে, এ কারণে তার মনে হয়েছে, লোকমান তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। রনি ছিল তার বন্ধুর মতো। রনি মারা যাওয়ায় সেও দুঃখ পেয়েছে। অথচ তাকে মেয়র গ্রেপ্তার করিয়ে দিয়েছেন। সে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল না বলে দাবি করে শরীফ।
শরীফ পুলিশকে জানায়, সে তখন মেয়রকে বলতে এসেছিল সামনে রোজা। রোজার মাসটি পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চায়। পরে সে আত্মসমর্পণ করবে অথবা আদালত থেকে জামিন নেবে। এই ক্ষোভের কারণে সে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে। কারাগার থেকে বের হয়ে বিষয়টি মোবারকের কাছে খুলে বলে। মোবারকের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে মেয়র লোকমান হোসেনের বিরোধ চলছিল। মোবারক জানতে চায় কিভাবে সহযোগিতা করতে পারে। সে মোবারকের কাছে একটি মোটরসাইকেল ও অস্ত্র চায়।
শরীফ পুলিশকে জানায়, লোকমান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সে নরসিংদী শহরে একাধিকবার মোবারকের সঙ্গে বৈঠক করে এবং বিভিন্ন কৌশল বের করে। শরীফের দাবি অনুযায়ী, হত্যাকাণ্ডের জন্য মোবারক মোটরসাইকেল জোগাড় করে। মোবারকের কথা অনুযায়ী তার ভাতিজি জামাই টঙ্গীর হাজী সেলিমের কাছে সে মোটরসাইকেল আনতে যায়। হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন আগে সে টঙ্গী থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ওই মোটরসাইকেলে নরসিংদীতে আসে। পরিকল্পনা শেষ করে হত্যার কয়েক দিন আগে মোবারক মালয়েশিয়া চলে যায়।
শরীফ পুলিশকে আরো জানায়, সে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়র লোকমানকে গাড়ি থেকে নামার পর গুলি করে হত্যা করবে এবং গুলি করার পর ওই মোটরসাইকেল দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সে কয়েক দিন আগে থেকে মেয়রের গতিবিধি লক্ষ করে এবং মোটরসাইকেল নিয়ে নরসিংদী শহরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু লোকমান গাড়ি থেকে নামার আগে প্রায় প্রতিটি স্থানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লোকজনের ভিড় হওয়ায় উপযুক্ত সুযোগের অভাবে সে হত্যা করতে পারেনি। এরপর শরীফ মেয়র লোকমানকে সামনে থেকে সরাসরি গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে সে মেয়র লোকমানকে পৌরসভায় তাঁর কার্যালয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ঘটনার দিন রাত ৮টার দিকে সদর সড়কের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কিছুটা দূরে মোটরসাইকেলে আওলাদ ও শরীফ অবস্থান নেয়। শরীফ আওলাদকে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পাঠায় লোকমান আছেন কি না, তা দেখতে। আওলাদ জানায়, লোকমান দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে মুড়ি খাচ্ছে।
আওলাদের কথা অনুযায়ী শরীফ মোটরসাইকেল নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনের সড়কে রাখে। মোটরসাইকেল থেকে নেমে মুখোশ পরে কার্যালয়ে ঢুকেই লোকমানকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলি চালায় সে। গুলি খেয়ে বসা অবস্থা থেকে লোকমান উঠে দাঁড়ান। এর পরই আরো চারটি গুলি করা হয়। এ সময় কয়েকজন লোক তাঁকে ধাওয়া করার চেষ্টা করলে দুটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে সে পালিয়ে যায়।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শরীফ হত্যাকাণ্ডের পরই সদরের ঘোষপাড়া এলাকার তাবলিগের সাথী সারোয়ার হোসেনের বাড়িতে যায় সে। রিভলবার ও গুলি সরোয়ারের কাছে রেখে পোশাক পরিবর্তন করে সে এবং তাবলিগের কথা বলে ঢাকায় চলে যায়।
শরীফের রেখে যাওয়া রিভলবারটি সারোয়ার দেড় লাখ টাকায় ঘোড়াদিয়ার মীর দেলোয়ার হোসেনের কাছে বিক্রি করে। কয়েক দিন পর শরীফ রিভলবারটি নেওয়ার জন্য সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সারোয়ার জানায়, সে রিভলবারটি পুকুরে ফেলে দিয়েছে। পুকুরের পানি সেচে অস্ত্রটি বের করতে লাখ টাকা লেগে যাবে। কিন্তু সারোয়ারের কথা বিশ্বাস হয়নি শরীফের। এরপর সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সে।
পুলিশ জানায়, কিলার শরীফ মূলত সারোয়ারসহ আরো দুই-তিনজনের সঙ্গে চলাফেরা করত। তারা ভোলার চরফ্যাশনের কলেজশিক্ষক আবদুল মজিদের অনুসারী। আবদুল মজিদ মূলত কালেমার দাওয়াত নামের একটি সংগঠনের প্রধান। এটিকে তারা তাবলিগি সংগঠন বলে দাবি করে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরই শরীফ তাবলিগ জামাতে যেত বলে সে পুলিশকে জানায়।
জিজ্ঞাসাবাদে শরীফ জানায়, হত্যাকাণ্ডে অন্য কোনো গ্রুপের লোককে সে ব্যবহার করেনি। এমনকি ঘটনাস্থলে আসতেও বলেনি। তবে বেশ কয়েকজন এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে বলে সে জানায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'শুরু থেকে আমরা বলছি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণ, পূর্ববিরোধ, আধিপত্যসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। সব বিষয়ই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।'
পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন, 'গ্রেপ্তারকৃতরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কে কিভাবে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে আমরা তা এখনই বলব না। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। মামলা সঠিক পথেই চলছে। আশা করি আমরা এ ঘটনায় আদালতে একটি সুন্দর অভিযোগপত্র দিতে পারব।'
মামলার বাদী নিহত লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বলেন, 'কিলার শরীফ হত্যাকারী, মোবারক তাকে ব্যবহার করেছে। মোবারকসহ মামলার অন্য আসামিরা মেয়র লোকমান হত্যার পরিকল্পনা করেছে। তাই কিলার শরীফের পাশাপাশি এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।'
কামরুজ্জামান বলেন, 'পুলিশ যদি এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার ষড়যন্ত্র করে নরসিংদীবাসী তা মেনে নেবে না। কারণ নরসিংদীবাসীর কাছে আজ পরিষ্কার, কাদের পরিকল্পনায় হত্যাকারীরা আমার ভাইকে হত্যা করেছে।'
গ্রেপ্তারকৃতরা রিমান্ডে
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গতকাল দুপুর পৌনে ২টায় গ্রেপ্তারকৃত চারজনকে আদালতে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ এদের মধ্যে হত্যা ও অস্ত্র মামলায় নাজমুল হাসান শরীফ ওরফে কিলার শরীফ, আওলাদ হোসেন ও সারোয়ার হোসেনকে ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। পাশাপাশি অস্ত্র মামলায় অন্য গ্রেপ্তারকৃত মীর দেলোয়ার হোসেনের চার দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। নরসিংদী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহার আবেদন মঞ্জুর করেন।
গত রবিবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশ ঢাকার খিলগাঁও থানার নন্দিপাড়া এলাকা থেকে কিলার শরীফ ও আওলাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতেই গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে সারোয়ার হোসেন ও ভোরে নরসিংদী সদর উপজেলার ঘোড়াদিয়া চকপাড়া থেকে মীর দেলোয়ার হোসেন শরীফকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় মীর দেলোয়ার হোসেন শরীফের কাছ থেকে পুলিশ একটি বিদেশি রিভলবার ও ২২টি তাজা গুলি, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কিলার শরীফের পরা কাপড় ও মুখোশ উদ্ধার করে।
পুলিশ জানায়, লোকমান হোসেন হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত মোট ১২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশ। এদের মধ্যে হত্যা মামলায় ১০ জন ও অস্ত্র মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের ১৬৪ ধারায় লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। তারা হলো মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আশরাফ হোসেন সরকার, সন্দেভাজন আসামি হাজি সেলিম মিয়া, মাহফুজ মিয়া, হাজী ফারুক, কাজী আলম। আর শাহীন মিয়া, নাসির হোসেন ও কাজী মাসুদুর রহমান ওরফে টিপ্পন কাজীকে জবানবন্দি ছাড়াই কারাগারে পাঠান আদালত। তাদের প্রত্যেককে দুই দফা ও তিন দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা
নরসিংদী পৌর মেয়রের শূন্যপদে আগামী ১৯ জানুয়ারি নির্বাচন ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিল ২২ ডিসেম্বর, যাচাই-বাছাই ২৭ ডিসেম্বর আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৪ জানুয়ারি।

No comments

Powered by Blogger.