শূন্যতার অপার বেদনা by নাসির আহমেদ

বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে, বাঙালির গত অর্ধশতাব্দীরও অধিককালের প্রগতিশীল আন্দোলনে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন এক অনির্বাণ প্রেরণা। যে কারণে পরিপূর্ণ বয়সে প্রয়াণ (৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩-১৩ ডিসেম্বর ২০১১) সত্ত্বেও তার বিদায় আমাদের মর্মাহত করেছে। এমন অপার শূন্যতার বোধ তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন যা বহু বছরেও পূর্ণ হওয়ার নয়। মাত্র কিছুদিন আগেও নিজের হাতেই লিখেছেন, ডিকটেশন দিতে রাজি হননি।


বার্ধক্য স্পর্শ করতে পারেনি তাকে। কথা বলার ক্ষেত্রে যেমন স্পষ্ট ছিল তার কণ্ঠস্বর, তেমনি চিন্তার ক্ষেত্রেও ছিলেন আশ্চর্য স্বচ্ছতার অধিকারী। যে কারণে এই বয়সেও সদা কর্মচঞ্চল ছিলেন কবীর স্যার। বাংলা একাডেমীর সভাপতি হিসেবে তিনি কেবল একটি আলঙ্কারিক চেয়ার মাত্র ছিলেন না, একাডেমীর প্রতিটি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতেন, সারগর্ভ বক্তৃতায় মুগ্ধ করতেন সবাইকে।
জীবনের অশীতিপর পর্যায়েও এতটা সক্রিয় যিনি তার মৃত্যুকে 'অকালমৃত্যু' বললেও অত্যুক্তি হয় না। মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী উদার ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি নমস্য, ব্যক্তিগত জীবনেও সর্বদাই প্রসন্ন আর শিশুর সারল্যে উদ্ভাসিত ছিলেন কবীর স্যার। কখনও তাকে ত্রুক্রদ্ধ হতে দেখিনি। কখনও রুচির সীমা লঙ্ঘিত হতে দেখেছি_ মনে পড়ে না। সত্তর দশক থেকে স্যারের সঙ্গে পরিচয়। শ্যামল ছায়ার মতো তার স্নেহের আশ্রয়। যখন যে আবদার নিয়ে গেছি, পূরণ করেছেন সহাস্যে। শরীরে কুলোয় না, তবু লিখেছেন। কথা বলতেন অনুচ্চ স্বরে, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে। অথচ এই সি্নগ্ধ কোমল মানুষটিরই কলম ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর। লেখার টেবিল থেকে রাজপথ কিংবা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি থেকে মৌলবাদবিরোধী দক্ষিণ এশীয় সম্মেলন_ সর্বত্র তিনি ছিলেন মানবতার পক্ষে অগ্রণী। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃত্বে দেখেছি কবীর স্যারকে। কী প্রাণবন্ত, সাহসী আর তারুণ্যখচিত। স্মরণে আসে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী 'নাইবা হলো পারে যাওয়া'র সেই এপিটাফ, যেখানে তিনি তার আত্মপ্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন নিজের নামের ছয়টি আদ্যাক্ষর দিয়ে ছয়টি পঙ্ক্তি রচনা করে। এপিটাফ যথার্থই।
'কখনো করেনি আপোষ অশুভের সাথে/ বীর না হলেও ভীরুতাকে কদ্যপি দেয়নি প্রশ্রয়/ রয়েছে সতত আঁকড়ে মহৎ আদর্শ মানবিকতার/ চৌদিকে যখন মৌলবাদী দানবের হিংস্র হুহুঙ্কার/ ধুলায় আচ্ছন্ন যখন তাবৎ শুভ মূল্যবোধ/ রীতির কপট বন্ধন সে তখনো অনায়াসে করেছে চুরমার।'
সামান্য অতিশয়োক্তি নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে আছে এর সত্যতা। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা হত্যার পর থেকে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। প্রায় ২০০ গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক, শিল্প ও সমাজ রাজনীতি-বিশ্লেষক এই পণ্ডিত সবসময় মানবিক মূল্যবোধের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলেন, ভীরুতাকে প্রশ্রয় দেননি। তিনি বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের স্বাধীনতার বহু আগেই পরিচিত করেছেন একের পর এক গ্রন্থ অনুবাদের মাধ্যমে। মার্কিন কথাসাহিত্য, ফরাসি ও জর্মন নাটক, শেক্সপিয়র থেকে লোরকা, ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসসহ এত বিচিত্র বিষয় অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের আলোকিত করেছেন, যার ঋণ অপরিশোধ্য। বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ, তাদের জীবন ও কর্মের ওপর একের পর এক মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক-শিল্পীদের অনেকের রচনাই তার অনুবাদে পেয়েছি আমরা। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য, নাটক, কবিতা ও ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তুলে ধরেছেন তিনি। যাদের লেখা অনুবাদ করেছেন তারা হলেন আনোয়ার পাশা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান প্রমুখ।
এই শিক্ষাবিদ সোমবার রাতে যে ঘুমিয়েছিলেন, সেই ঘুমের মধ্যেই চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। সকালে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে দেখা গেল স্পন্দনহীন তার নিথর দেহ। তার জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কিশোর-তরুণদের একটি মাসিক কাগজ 'প্রত্যাশা'য়। সেখানে বলেছিলেন, 'আমি আরও কিছুদিন সুস্থভাবে তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।' কিন্তু মৃত্যু সে স্বপ্ন কেড়ে নিল। তিনি বাহ্যিক অস্তিত্বে হারিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু বহুকাল আমাদের মানসলোকে এবং ভাবীকালের অসাম্প্রদায়িক মানুষের কাছে স্পন্দিত হবে তার মহৎ দর্শন। তার শূন্যতার অপার বেদনার মধ্যেও সান্ত্বনা এখানেই।

নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.