নির্মম নিষ্ঠুর বর্বর by পিনাকি দাসগুপ্ত

স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পড়াশোনা করায় ডান হাতের পাঁচটি আঙুল হারাতে হয়েছে নরসিংদী সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী হাওয়া আক্তার জুঁইকে। বিদেশ ফেরত স্বামী রফিকুল ইসলাম ওড়না দিয়ে চোখ বেঁধে গলায় নেকলেস পরিয়ে দেওয়ার কথা বলে চাপাতি দিয়ে জুঁইয়ের ডান হাতের পাঁচটি আঙুল কেটে নেয়। পরে কাটা আঙুল ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে। নির্মম এ ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের জিয়া কলোনিতে।
এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থানায়। পুলিশ রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে। নরসিংদী শহরের ভেলানগরের ইউনুছ মিয়ার মেয়ে জুঁই। তিনি নরসিংদী সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিন বোন এক ভাইয়ের
মধ্যে জুঁই বড়। পরিবারের সম্মতিতে তিন বছর আগে জুঁইয়ের বিয়ে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নূরজাহানপুর গ্রামের বাতেন মিয়ার ছেলে দুবাই প্রবাসী পঞ্চম শ্রেণী পাস রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। বিয়ের পর রফিকুল ইসলাম তার স্ত্রী জুঁইকে লেখাপড়া বন্ধ রাখতে চাপা দেয়। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে জুঁই স্বামীর বাধা সত্ত্বেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। ৪ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন জিয়া কলোনির ১০৭/৫ ল্যান্স করপোরাল শফিকুল ইসলামের বাসায় রফিকুল ইসলাম নির্মম এ ঘটনাটি ঘটায়।
সেদিন যা ঘটেছিল : নরসিংদীর বাসায় সোমবার দুপুরে জুঁইয়ের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। সে সময় ডান হাতে ছিল ব্যান্ডেজ। জীবনের সেই কালো সময়ের কথা বলতে গিয়ে জুঁই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জুঁই ও তার মা পারভীন বেগম জানান, ৪ ডিসেম্বর রফিকুল দুবাই থেকে দেশে ফেরে। দেশে ফেরার সাত-আট দিন আগে রফিকুল মোবাইল ফোনে জুঁইকে জানায়, তার ব্যবহারের জন্য একটি মোবাইল ফোন সেট, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান ব্যবহার সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। ওইসব জিনিস যেন রফিকুলের দুলাভাইয়ের ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে জুঁই নিজে গ্রহণ করে।
গত ১ ডিসেম্বর জুঁই তার চাচাতো ভাই সোহাগকে নিয়ে রফিকুলের বোনের বাসায় যান। জুঁইকে পেঁৗছে দিয়ে সোহাগ নরসিংদী চলে আসে। জুঁই স্বামীর বোনের বাসায় অবস্থান করে দেখেন তার জন্য কোনো কিছুই পাঠানো হয়নি। ঘটনার তিন দিন পর ৪ ডিসেম্বর ভোরে আকস্মিক তার স্বামী রফিকুল ইসলাম ওই বাসায় উপস্থিত হয়। জুঁই ঘুম থেকে উঠে স্বামীর উপস্থিতিতে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি চিন্তিত হয়ে পড়েন। জুঁইকে ডেকে বাসার একটি রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় রফিকুল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয় রফিকুল। পরে সুকৌশলে রফিকুল প্রথমে ওড়না দিয়ে জুঁইয়ের চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেয়। পরে বেঁধে ফেলে হাত-পা। এরপর রফিকুল জুঁইকে আশ্বস্ত করে, 'এসব কিছু না। দুষ্টুমি মাত্র। তোমার হাত দুটো টেবিলে রাখো। আমি তোমার গলায় দামি নেকলেস পরিয়ে দেব।' এত কিছুর পরও জুঁই স্বামীর কথা বিশ্বাস করেন। তা ছাড়া বিশ্বাস না করলেও তার তখন কিছুই করার ছিল না। এ সময় স্বামী রফিক চাপাতি দিয়ে জুঁইয়ের ডান হাতের পাঁচটি আঙুল কেটে ফেলে। কিছু সময়ের মধ্যেই জুঁই রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর রফিকুল জুঁইয়ের অপর হাত কাটার প্রস্তুতি নেয়। এ সময় রফিকুলের বোন ও তার জামাতা সেনাসদস্য শফিকুল ইসলাম চিৎকার করে দরজা খুলতে বলেন। এক সময় রফিক দরজা খোলার পর তারা জুঁইকে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জুঁইকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারদের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে অসুস্থ জুঁই হাসপাতালের জনৈক চিকিৎসকের মোবাইল ফোন থেকে নরসিংদীতে তার বাবাকে রফিকুলের এই নির্মমতা জানান। পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ৬ ডিসেম্বর জুঁইকে নরসিংদীতে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় নরসিংদীর মানবাধিকার কর্মীরা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তারা রফিকুলের শাস্তিও দাবি করেন।
ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, ঘটনা শোনার পরপরই পুলিশ রফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। রফিকুল নিজ হাতে জুঁইয়ের হাতের পাঁচটি আঙুল কেটে ফেলার কথা স্বীকার করে। রফিক জানায়, জুঁই লেখাপড়া শিখলে তাকে যে কোনো সময় তালাক দিতে পারত। এ কারণেই জুঁইয়ের ডান হাতের পাঁচটি আঙুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলা হয়। যে ছুরি দিয়ে আঙুল কাটা হয়েছে তা উদ্ধার করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.