রেলওয়ে : ষড়যন্ত্র আর দুর্নীতির কবলে by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রেলওয়ে বিভাগের জন্য একজন পৃথক এবং স্বতন্ত্র মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞ রাজনীতিক এবং আলোচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই দায়িত্ব পেয়েছেন। এত দিন রেলওয়ে বিভাগ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত ছিল, যেখানে সড়ক এবং সড়ক পরিবহনের দৌরাত্ম্য ছিল অনেক বেশি। প্রধানমন্ত্রী যে কেবল দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছেন, তা-ই নয়, এটি সময়োচিত একটি বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত।


আমরা নিশ্চিত যে সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষ করে রেলযাত্রীরা এ সিদ্ধান্তে মহা খুশি। তবে কেন এ উচ্ছ্বাস, তা আলোচনা করার আগে রেলপথ সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা বলা প্রয়োজন। বিশ্বে ব্রিটেনে প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে রেলপথ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ভারত শাসন করছিল ইংরেজরা। তাও আবার এক কম্পানির মাধ্যমে, যার নাম ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। ১৮৫৪ সালে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ চালু করা হয়। এর পর নেটওয়ার্ক বাড়তে বাড়তে গোটা বাংলার গণপরিবহন হিসেবে রেলপথের বিস্তার লাভ করে। ইতিমধ্যে ১৯১৩-১৪ সালে পাবনার পাকশীতে পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করা হয়, যা হার্ডিঞ্জ সেতু নামে পরিচিত। ফলে শিয়ালদহ (কলকাতা) থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ রেল যোগাযোগ গড়ে ওঠে। অবিভক্ত বাংলার ৯টি জেলার ভেতর দিয়ে এই ডাবল ট্র্যাক ব্রডগেজ লাইন চলে গেছে। এদিকে পূর্ব বাংলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মূল লাইনসহ অনেক শাখা লাইন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হলো। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হলো। ব্রিটিশের শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানি শাসকদের পাল্লায় পড়লাম। অন্যান্য বিষয়ের মতো রেলওয়ে বিভাগও বঞ্চনার বিষয় হলো। শিয়ালদহ-শিলিগুড়ি রুটের সিংহভাগ আমাদের কপালে জুটেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার একটি ট্র্যাক উঠিয়ে দিল। ১৯৬২ সালের আগ পর্যন্ত রেলওয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ছিল বাংলার রাজধানী। তার আগে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল। সে সময় খুলনা শহরের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সরাসরি রেল যোগাযোগ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে এসে দর্শনা হয়ে পূর্ব পাকিস্তান ঢুকতে হতো। অতএব সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য ১৯৫১-৫২ সালে যশোর-দর্শনা রুটে ৬৯ দশমিক ২৩ কিলোমিটার রেলপথ বসানো হয়। পাকিস্তান আমলে এটাই ছিল উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সে আমলে দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব বাংলার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নদীপথ এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের প্রধান চলাচলের মাধ্যম ছিল ট্রেন।
স্বাধীনতার পর একদিকে যেমন সড়কপথের উন্নতি হয়, তেমনি তার চেয়ে বেশি উন্নতি সাধিত হয় সড়ক পরিবহনে।
১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর তো সড়ক পরিবহনের বৃদ্ধি শতকরা হিসাবে মনে হয় কয়েক শ হবে। এই অগ্রগতিতে আক্ষেপ বা ঈর্ষার কিছু ছিল না। কিন্তু যা দুর্ভাগ্যজনক, তা হলো রেলওয়ে বিভাগের অধঃপতন। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন রেলপথের সীমানা ছিল দুই হাজার ৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার এবং স্টেশনের সংখ্যা ৪৬৬টি। ১ জুলাই ২০০০ সালে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল দুই হাজার ৭৬৮ কিলোমিটার এবং স্টেশনের সংখ্যা ৪৫৫টি। যতদূর জানা গেছে, তাতে স্টেশনের সংখ্যা আরো কম হবে। আর রেলগাড়ির অবস্থা_কয়েকটি তথাকথিত আন্তনগর ট্রেন ছাড়া বাকি ট্রেনে ওঠা যায় না। বাতি নেই, বাথরুম দুর্গন্ধময় এবং অব্যবহারযোগ্য। আর সময় বলে কোনো কথা নেই। যেসব ইঞ্জিন দিয়ে লোকাল ট্রেন চালানো হয়, তা দেখলে হতদরিদ্র কৃষকের জীর্ণ বলদ দিয়ে জমি চাষ করার দৃশ্য মনে পড়ে যায়। সবচেয়ে বড় দুঃখের কথা যে জাতীয় নেতা মনসুর আলীর পর আর কোনো যোগাযোগমন্ত্রী আসেননি, যিনি রেলওয়ের প্রতি সামান্যতমও আগ্রহ দেখিয়েছেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। দুই সামরিক শাসকের বদৌলতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। সড়ক পরিবহনের নিয়ন্ত্রকদের অনেকেই ক্ষমতাবান রাজনীতিক। রেলওয়ে বিভাগে কতটুকু ব্যয় হবে, তা তাঁরা কৌশলে ঠিক করে দিতেন। তাঁদের প্রতিনিধি মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের আমলারা রেলওয়ের বরাদ্দের টাকাও ব্যয় করে ফেলতেন, এসব অভিযোগই পুরনো। তাঁরা কতটা শক্তিশালী, এর একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বেশ আগের কথা। যোগাযোগমন্ত্রী রাজশাহী গেছেন, একটি আন্তনগর ট্রেন উদ্বোধন করা হবে। ঢাকায় আসবেন যমুনা সেতু দিয়ে। ভোরে ট্রেন ছাড়ার কথা। সড়ক পরিবহনের নেতাদের চাপে সময় পরিবর্তন করা হলো। অতএব দেখা যাচ্ছে যে রেলওয়ে বিভাগ ভূতের মতো পেছনে হেঁটেছে। দু-একজন বাকপটু মন্ত্রী কিছু অবাস্তব কেচ্ছা-কাহিনী শুনিয়েছেন। যেমন নাজমুল হুদা ঢাকা-চট্টগ্রাম পথে চুম্বক ট্রেনের কথা বলেছিলেন। আর প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর এপার-ওপার কোনো পারে রেললাইন না থাকা সত্ত্বেও তথ্যপ্রযুক্তির বদৌলতে দোতলা সেতুতে ট্রেন দৌড়ানোর দৃশ্য দেখালেন।
রেলমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, রেলকে ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। সড়কপথ তথা সড়ক পরিবহন আরো উন্নত হোক, তাতে তো কারো আপত্তি করার প্রশ্ন ওঠে না। ভারত এবং চীন উভয় দেশে সড়কের যথেষ্ট_যথেষ্ট বললে কম হয়, অস্বাভাবিক উন্নতি হচ্ছে। চীন থেকে লন্ডন পর্যন্ত ট্রেন চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভারতে গতিসম্পন্ন না হলেও নিত্যনতুন ভালো ভালো ট্রেন চালু করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে রেলওয়ে বিভাগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অতএব প্রথম কাজ হলো, রেলওয়েকে অসাধুদের থাবা থেকে রক্ষা করা। রেলওয়ের জন্য প্রথমে প্রয়োজন বাস্তব, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা। স্বাধীনতার আগে দেখেছি, লোকাল ট্রেনও মোটামুটি ভালোভাবে রান করেছে। অতি দ্রুত লোকাল ট্রেনের উন্নতি করা দরকার। আর বর্তমান সড়কপথ যে রকম বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে, তাতে মানুষ এখন ট্রেনকে বিকল্প হিসেবে খুবই গুরুত্ব দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রেলওয়ের উন্নতি করতে হলে অতিকথনের প্রয়োজন নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারত রেলওয়েতে যে কিছুটা উন্নত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের রেলওয়ের আশু প্রয়োজন সম্ভবত কোচ এবং ইঞ্জিন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। অবশ্য হাসিনা-মনমোহন বৈঠকে এ নিয়ে কিছু স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা, ট্রানজিট_এসব নিয়ে এত কথাবার্তা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এর মধ্যে রেলওয়ের ব্যবসার কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা আমরা, আমজনতা কিছু জানতে পারছি না। এত দিন রেলওয়ে বিভাগ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিভৃতচারী হিসেবে বিরাজ করেছে। এখন পৃথক অস্তিত্ব হয়েছে। আশা করি, এর জনসংযোগ বিভাগ সক্রিয় হয়ে জনগণকে অগ্রগতি এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করবে। স্বাধীনতার আগে রেলওয়ে বিভাগকে পরামর্শ দিতে একটি পরামর্শক কমিটি ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বেসরকারি এবং স্বনামধন্যদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত হতো। অঞ্চলবিশেষে এ ধরনের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে রেলমন্ত্রী সবচেয়ে বড় যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন, তা হলো রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং তা বাস্তবায়নে। কারণ এ ক্ষেত্রে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। প্রায় চার দশক রেলওয়ে বিভাগ ছিল খুবই অবহেলিত। কোনো কাজকর্ম হয়নি। পরিকল্পনা বলতে কিছু নেই। উচ্চপদে কয়েকজন আমলা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা তাঁদের স্ক্রিপ্ট বেনিফিট নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এসব কারণে নিচে কাজকর্মে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, তা রেলওয়ের সংঘটিত দুর্ঘটনা দেখলে বোঝা যায়। রেলওয়ে বিভাগে মাঠপর্যায়ে অনেক পদ শূন্য রয়েছে।
আমাদের বিশ্বাস, যিনি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি একজন দূরদর্শী ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিক। অতএব তিনি মূল সমস্যা অনুধাবন করতে পারবেন। কেননা অভিজ্ঞ রাজনীতিকের চেয়ে দক্ষ প্রশাসক কেউ হতে পারেন না। আরো বড় কথা, তিনি রেলওয়ের সেকাল-একাল_দুটোই দেখেছেন। পরিশেষে আর একটি কথা বলতে চাইছি, ঢাকা শহরের যানজট কমাতে এবং নাগরিকের যাতায়াত-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে রেলওয়ে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। পৃথিবীর বহু শহরে স্বাভাবিক, মেট্রো এবং সাবওয়ের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ দৈনন্দিন প্রধান শহরে যাওয়া-আসা করে। আমরা মনে করি, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের উন্নতি ঘটিয়ে যাত্রীদের কষ্ট লাঘব করা এবং ঢাকার ওপর জনচাপ কমানো যেতে পারে। রেলওয়ে কিভাবে ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, কারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে রেলকে পঙ্গু করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, সর্বাগ্রে এসব বিষয় অনুসন্ধানক্রমে প্রতিকার জরুরি। যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি জেনেও সড়ক বাহনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে। রেলবিমুখ যাত্রীদের আবার রেলমুখী করা কোনোই দুরূহ বিষয় নয়। সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি পুরো ব্যবস্থাকে একেবারে ঢেলে সাজাতে হবে।

লেখক : সাবেক ইপিএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.