জয়ন্ত গুপ্ত-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং জেনারেল জ্যাকব

লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে যখন পাকিস্তানের তদন্ত কমিশন জিজ্ঞেস করে, তাঁর অধীনে ঢাকায় ৩০ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি আত্মসমর্পণ করলেন, তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, 'জেনারেল জ্যাকব আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।' পাকিস্তানের এই জেনারেল একই কথা তাঁর 'বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' গ্রন্থেও লিখেছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকবের অনেক নাম আছে।


তিনি বহুভাবে মানুষের কাছে সুপরিচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে চেনেন 'জ্যাকব সাব' হিসেবে। আর পাকিস্তানিরা তাঁকে ডাকে জিউ জ্যাকব নামে, যে জিউ নাকি তাদের পরাজয়ের জন্য প্রধানত দায়ী।
দেশ তার সেনাদের কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে_এমন প্রশ্নে তাঁকে মোটেই সন্তুষ্ট মনে হয়নি। তিনি নয়াদিলি্লর টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, 'দেশ নিজ সেনাদের কথা মনে রাখে না। দেশের অতিজরুরি অবস্থার সময় আমাদের ডাকা হয়। তারপর অবস্থা স্বাভাবিক হলে আমাদের কথা দেশ ভুলে যায়। আমাদের দেশে এমনকি একটি জাতীয় যুদ্ধ জাদুঘরও (ওয়ার মিউজিয়াম) নেই। ১৯৭১ সালের বিজয় ছিল একটি বড় ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পণের মতো এত বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা আর ঘটেনি। কিন্তু জনগণ সেটাকে স্মরণে রাখেনি বলে মনে করা হয়।'
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন এই জেনারেল ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়, ইন্দো-পাক যুদ্ধের সময় পূর্বাঞ্চলে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিযানের পরিকল্পনাটি করেছিলেন এই জেনারেল জ্যাকব। অবসর গ্রহণের পর জ্যাকব যুদ্ধের সময়কার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর কিছু বক্তব্য দেশকে আহত করেছে এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিছুসংখ্যক বইয়ের কিছু কিছু জায়গায় জেনারেল জ্যাকব ভারতীয় সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি কিভাবে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পেঁৗছেছিলেন, তা বর্ণনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সেই সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার স্ত্রী সরকারি গাড়িতে তাঁর স্থানটি কিভাবে দখল করে নিয়েছিলেন, সেই কথা।
জেনারেল জ্যাকব বলেছেন, 'অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে আমি সব সময় অনুধাবন করেছি, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা কত বড় ভূমিকা পালন করেছে। তারা পাকিস্তানিদের সব সময় অস্থির করে রেখেছে এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাটি ছিল খুবই কঠিন। আমরা বাংলাদেশে এক হাজার ৪০০ সেনা হারিয়েছি এবং চার হাজার সেনা আহত হয়েছে। হতে পারত এই সংখ্যা অনেক বেশি। আমিই প্রথম আমার বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনগণ বহুদিন আগেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আজ বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত ইতিবাচক। এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকা উচিত।'
১৯৭১ সালের সেনাবাহিনীর এই বীর সেনা কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যদের অধিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে সোচ্চার রয়েছেন। তাঁর মতে, অন্য যেকোনো কিছুর আগে সেনাদের প্রয়োজন ইজ্জত বা সম্মান। এই জেনারেল মনে করেন, ইজ্জত বিষয়টিই সেনাবাহিনী সঠিকভাবে পাচ্ছে না। তিনি মনে করেন, আইপিএস এবং আইএএস সার্ভিস অফিসারদের সমমর্যাদা থাকা উচিত। তিনি মনে করেন, প্রতিটি যুদ্ধের পরই এই সমমর্যাদা বরং কমেছে। তিনি আমলাতন্ত্রের 'সিভিল কন্ট্রোল অব দ্য আর্মড ফোর্সেস' এবং 'সিভিল সার্ভিস কন্ট্রোল অব দ্য আর্মড ফোর্সেস'-এর ঘোরবিরোধী। তিনি যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীকে আধুনিক করে প্রস্তুত রাখার প্রস্তাব করে থাকেন।

লেখক : দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার কলকাতা প্রতিনিধি। টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে ভাষান্তর : মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.